প্রবন্ধ রচনা: বৃত্তিমূলক শিক্ষার বা কর্মমুখী শিক্ষা রচনা

বৃত্তিমূলক শিক্ষা

ভূমিকা :

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার । শিক্ষার আলাে ছাড়া মানুষ পশুস্তর থেকে মনুষ্যত্বের স্তরে উন্নীত হতে পারে না । শিক্ষার উপযােগিতা মানবিকতাকে অতিক্রম করে আজ বৃত্তি বা জীবিকার ক্ষেত্রেও বিস্তৃত । অশিক্ষিত মানুষের শ্রমের মূল্য ও গুরুত্ব নিতান্তই কম । প্রকৃতপক্ষে কর্মবিমুখ ও জীবনবর্জিত শিক্ষার উপযােগিতা আজ নেই বললেই চলে । আধুনিককালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে সবার আগে প্রয়ােজন কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা ।

বৃত্তিমূলক শিক্ষা কী :

সাধারণ শিক্ষার সাথে বৃত্তিমূলক শিক্ষার একটি মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান । এ শিক্ষায় মানুষকে একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় প্রকার জ্ঞানদান করা হয় । শিক্ষা সমাপনান্তে একজন শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট বিষয়েই দক্ষতানুযায়ী কাজ বেছে নিতে পারে এবং পেশাগত জীবনে শিক্ষাকে প্রয়ােগ করতে পারে । কৃষি , শিল্প , চিকিৎসা বা কারিগরি ক্ষেত্রে জ্ঞানলাভের পর অর্জিত জ্ঞান জীবিকার প্রয়ােজনে কাজে লাগিয়ে একজন মানুষ যদি জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে । বর্তমানে কর্মমুখী শিক্ষার জনপ্রিয়তা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

প্রচলিত শিক্ষার ত্রুটি :

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামাে তৈরি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের হাতে । তারা নিজেদের স্বার্থে কিছু কেরানি সৃষ্টির মানসিকতায় এদেশের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছিল । আমাদের দেশে এখনাে সেই শিক্ষাব্যবস্থাই চালু রয়েছে । ফলে শিক্ষার সাথে জীবন এবং কর্মযােগ না থাকায় এদেশে তথাকথিত সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের হার বাড়লেও দক্ষ কর্মী সৃষ্টি হয় নি । অধুনা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটলেও কারিগরি জ্ঞান ও প্রায়ােগিক শিক্ষার অভাবে এদেশের বিজ্ঞান শিক্ষাও অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে । সেজন্যই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়েও অনেকে বেকারত্ব ভােগ করছে কিংবা প্রশাসনিক পদে চাকরি করছে । প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার এই আত্মঘাতী ত্রুটির কারণেই আজ কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়ােজন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে ।

বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা :

আমাদের মতাে গরিব এবং অধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়ােজন সর্বাধিক । কেননা , বৃত্তিমূলক শিক্ষা জনসংখ্যাকে জনশক্তি বা মানবসম্পদে পরিণত করে । বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানের দ্রুত উন্নতির পেছনে কাজ করেছে সেদেশের কঠোর পরিশ্রমী জনশক্তি । আর তারা এ কর্মীবাহিনী সৃষ্টি করেছে সর্বস্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে । বর্তমানে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগ । এ যুগে শুধু কলম নিয়ে জীবিকার্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে । কারণ কম্পিউটারের মতাে কর্মপট যন্ত্রের আবিষ্কার কলমের ব্যবহারকে সীমিত করে ফেলেছে । উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় যে , তাদের উন্নতির মূলে রয়েছে প্রযুক্তি জ্ঞান ও তা বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যবহারে দক্ষতা । কলকারখানা স্থাপন , পরিচালনা , অবকাঠামাে নির্মাণ প্রভৃতি ছাড়া কোনাে দেশই শিল্পায়িত হতে পারে না তথা উন্নতি লাভ করতে পারে না । এক্ষেত্রে যান্ত্রিক কলাকৌশলের ব্যবহারিক প্রয়ােগের গুরুত্ব সর্বাধিক । অপরদিকে বৃত্তিমূলক শিক্ষাও কিন্তু কারিগরি শিক্ষার মাঝে সীমাবদ্ধ নয় । ডাক্তার , আইনজীবী , শিক্ষক প্রভৃতি বৃত্তিনির্ভর পেশাজীবী বৃত্তিমূলক শিক্ষার ফসল । বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রত্যেক মানুষের আগ্রহ ও দক্ষতানুযায়ী পেশা নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় । ফলে প্রতিভা ও কর্মপ্রেরণার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় । মােটকথা , বৃত্তিমূলক শিক্ষা মানুষের কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীল প্রতিভাকে বিকশিত করে বেকারত্ব দূর করে ।

কর্মমুখী শিক্ষা প্রসারের উপায় :

বাংলাদেশে কর্মমুখী বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে । দেশে প্রকৌশল , বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসাবিদ্যা সম্প্রসারিত হয়েছে । এছাড়াও প্রকৌশল , পলিটেকনিক , গ্রাফিক আর্ট ও ভােকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং লেদার ও টেক্সটাইল টেকনােলজি কলেজ , ভেটেরনারি কলেজ ইত্যাদির মতাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে । বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত ছােটখাটো কারিগরি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে । এছাড়া হােটেল ব্যবস্থাপনা , অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা , উদ্যান পরিচর্যা , বিজ্ঞাপন ব্যবসা , সূচিশিল্প , মুদ্রণ , মৎস্য চাষ , গবাদিপশু ও হাঁস - মুরগি পালন , ফলমূল চাষ , কম্পিউটার চালনা , কুটির শিল্প ইত্যাদি পেশা ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে । তবে সব মিলিয়ে এরপরও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিদ্যমান সুযােগ এখনও বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় নগণ্য । তাই পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে । এজন্যে প্রয়ােজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে । সাধারণ শিক্ষার মাঝেও প্রায়ােগিক শিক্ষাকে স্থান দিতে হবে । শিক্ষা গ্রহণের পর যাতে মানুষ সংশ্লিষ্ট কাজ খুঁজে পায় সেজন্যে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে । বিজ্ঞাননির্ভর কৃষিব্যবস্থা , কারখানা স্থাপন ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে । শিক্ষা শেষে মানুষ যাতে চাকরির বদলে নিজেই ছােটখাটো প্রকল্প গ্রহণ বা কারখানা স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারে সেজন্য মূলধন সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে হবে । বিদেশেও বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির ব্যবস্থা করতে হবে ; যাতে শিক্ষা শেষে মানুষ কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয় ।

বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারে গৃহীত উদ্যোগ :

প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার সৃষ্টির পটভূমিতে সরকার বৃত্তিমূলক শিক্ষাবিস্তারে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । সরকার কারিগরি শিক্ষাবাের্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর স্থাপন করেছে । সরকার মেয়েদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র পলিটেকনিক স্থাপন করার পদক্ষেপ নিয়েছে । এছাড়া ফেনীতে একটি কম্পিউটার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেছে একটি পূর্ণাঙ্গ যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র । যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় প্রতিটি জেলায় উদ্যমী তরুণ তরুণীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি স্বকর্মসংস্থানের সুবিধার্থে ঋণ সহায়তা দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে । বিভিন্ন এনজিও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও ঋণদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । সরকার সম্প্রতি জাপানের সাথে শ্রমিকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে । মাধ্যমিক স্কুলগুলােতে চালু করেছে ট্রেড কোর্স । কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা বৃদ্ধি করেছে । এসব কারণে সাম্প্রতিককালে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে ।

উপসংহার :

বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার কারণ বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব । ভিক্ষুক বা বেকারের হাতকে কর্মীর বলিষ্ঠ হাতে রূপান্তরের জন্যে এবং দেশকে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মােকাবেলায় এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অবশ্যই সম্প্রসারিত করতে হবে । ড . ফরাস উদ্দিন বলেছেন- ‘ Vocational education is important and essential for our development which must be evaluated sooner or later . '


আরো পড়ুনঃ