প্রবন্ধ রচনা: তোমার প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলী আমার কাছে খুব ভাল লাগে ।

আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে । তাই তিনি আমার প্রিয় লেখক/সাহিত্যিক। বাংলার সাহিত্যাকাশে যে কয়েকজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক নক্ষত্রের মতই দীপ্তিমান , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম । বস্তুতঃ কাহিনী - নির্ভর সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় । তাই তাকে কথাশিল্পী বা কথা সাহিত্যিক বা কথার যাদুকর নামে বিভূষিত করা হয় ।

সাধারণ মানুষের বিশেষতঃ বাঙ্গালী সমাজের সুখ - দুঃখ , হাসি - কান্না নিয়েই শরৎচন্দ্রের সাহিত্য রচিত । সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে যে বেদনা ও গ্লানি আছে , তিনি তার করুণ চিত্র অঙ্কন করেছেন । সমাজে ভাল - মন্দ , পাপী - তাপী , জ্ঞানী - মূখ কত বিচিত্র ধরনের মানুষ আছে । শরৎচন্দ্র তার লেখনীতে কাকেও বাদ দেন নি । তিনি তাঁর সাহিত্য অঙ্গনে সবাইকে নিয়ে এক জমজমাট আসর বসিয়েছেন । সমাজের এমন ব্যাপক বিচিত্র চিত্র বাংলা সাহিত্যে আর নেই বললেই চলে।

শরৎচন্দ্রের পর্যবেক্ষণশীলতা ও অন্তদৃষ্টি ছিল অসাধারণ । তিনি সংসারের গভীরে প্রবেশ করে পুখানুপুঙ্খরূপে মানুষের বিচার বিশ্লেষণ করে দোষ - ত্রুটি নির্ণয় করেছেন । সংসারে নারীজাতির চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি তিনি বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন । অতি তুচ্ছ ও অতি সাধারণ ঘটনাকেও তিনি এমনভাবে রূপ দিয়েছেন যে , আমরা আকৃষ্ট না হয়ে পারি না । মদ্যপায়ীর মধ্যেও যে মনুষ্যত্ব আছে , পতিতার মধ্যেও ন্যায়বােধ আছে , সংযমীর মধ্যেও অসংযম আছে , তা তিনি সার্থকভাবে চিত্রিত করেছেন । তিনি তুচ্ছতা ও সংকীর্ণতার মধ্যেও রূপ - রস - রঙের সন্ধান পেয়েছেন ।

শরৎচন্দ্রের মত দরদী লেখক বাংলা সাহিত্যে বিরল । দুঃখীর দুঃখে তিনি ব্যথিত হয়েছেন , বঞ্চিতের বঞ্চনায় তিনি ভারাক্রান্ত হয়েছেন । তাই তাঁর দরদ ভরা কাহিনী মর্মস্পর্শী হয়ে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে । ব্যথাদীর্ণ চিত্ত দেখলেই তাঁর সুকোমল অনুভূতি জেগে উঠত । তার দরদী মন বঞ্চিত নারীর প্রতি সহৃদয়তা দেখাতে , নারীর লাঞ্ছনা , গঞ্জনায় সমবেদনা জানতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি । তার কাহিনীর রমা , জ্ঞানদা , সাবিত্রী , অভয়া , মাধুরী , হৈমন্তী , বিলাসীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে তার দরদভরা অন্তরের পরিচয় পাওয়া যায় । জীবনে চলার পথে যে সমস্ত নারীর পদস্খলন ঘটেছে , তাদের কথাও তিনি জানতে চেয়েছিলেন । তাদের অব্যক্ত ব্যথা বেদনাকে তিনি রূপ দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি।

সামাজের গোঁড়া সংস্কার , যুক্তিহীন বাধা - নিষেধ , অশিক্ষিত পরিবারের নানা কদর্য দিক তার দৃষ্টি এড়ায়নি । এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি সােচ্চার হয়েছেন এবং প্রয়ােজনে প্রতিবাদও করেছেন ।

সাহিত্যে রসসৃষ্টিতে শরৎ ছিলেন সিদ্ধহস্ত । সমাজ যদি বাধা প্রদান না করে , তবে প্রেম মানুষকে কতখানি বড় , কতখানি উদার করে , তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন । প্রেম - কাহিনী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি অপূর্ব দক্ষতার সাথে হাস্যরস পরিবেশন করেছেন । তার প্রিয়নাথ ডাক্তারকে ভােলা যায় না , নতুনদার কথা উঠলে হাসি পায় , শ্রীনাথ বহুরূপীকে দেখলে মনে কৌতুক জাগে । অবশ্য তার কাহিনীতে অনেক মধুর রস শেষে করুণ রসে পরিণত হয়েছে । উন্মাদিনী কিরণময়ী , মৃত্যুপথযাত্রী সুরেন্দ্রনাথ , কাশিবাসিনী রমা যেন দুঃখ - বেদনার মূর্ত প্রতীক । তাদের চোখের পানি পাঠকের হৃদয়কেও সিক্ত করে ।

পরিশেষে , শরৎচন্দ্রের রচনাশৈলীর কথা না বললে অপূর্ণ থেকে যায় । তাঁর লেখার ভঙ্গিমা অত্যন্ত সহজ , সরল । অনেক সাজসজ্জাবিহীন চেহারার মধ্যে যেমন একটা প্রসন ভাব ফুটে উঠে , শরৎচন্দ্রের সরল লেখনীর মধ্যেও তেমনি সাহিত্যিক শ্রী ও সৌষ্ঠব ফুটে উঠেছে , সরল প্রকাশভঙ্গির মধ্যেও গভীর তথ্য নিহিত রয়েছে । এ সমস্ত কারণে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক ।