অস্থিতিস্থাপকতা (Inelasticity)
অস্থিতিস্থাপকতা (Inelasticity)
অস্থিতিস্থাপকতা হলো স্থিতিস্থাপকতার ঠিক বিপরীত ধারণা। পদার্থবিজ্ঞানে এবং প্রকৌশলবিদ্যায় এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করার পর তার আকারের স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে অথবা কোনো সংঘর্ষে শক্তির অপচয় হয়, তখন তাকে অস্থিতিস্থাপকতা বা অস্থিতিস্থাপক আচরণ বলা হয়।
অস্থিতিস্থাপকতা কী?
সাধারণভাবে, বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর আকৃতি বা আয়তনের পরিবর্তন ঘটার পর, বল অপসারণ করলে যদি বস্তুটি আর তার আগের অবস্থায় ফিরে না আসে, তবে তাকে অস্থিতিস্থাপক বস্তু বা নমনীয় বস্তু (Plastic Body) বলা হয়।
অন্যদিকে, বলবিদ্যার (Mechanics) ভাষায়, যখন দুটি বস্তুর সংঘর্ষে মোট গতিশক্তি (Kinetic Energy) সংরক্ষিত থাকে না (অর্থাৎ সংঘর্ষের আগের ও পরের গতিশক্তি সমান হয় না), তখন তাকে অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ (Inelastic Collision) বলা হয়।
অস্থিতিস্থাপক আচরণ ও পদার্থ
বাস্তব জীবনে পুরোপুরি বা ১০০% অস্থিতিস্থাপক বস্তু পাওয়া কঠিন, তবে কিছু বস্তু আছে যা এই আচরণের খুব কাছাকাছি। এদের সাধারণত "প্লাস্টিক" বা নমনীয় বস্তু বলা হয়।
- উদাহরণ: কাদা মাটি (Wet Clay), পুটি, মোম, বা সিসার গুলি।
- বৈশিষ্ট্য: আপনি যদি এক দলা কাদা মাটির ওপর চাপ দেন, তবে সেটি চ্যাপ্টা হয়ে যাবে এবং চাপ সরিয়ে নিলেও আর গোল অবস্থায় ফিরে আসবে না। এই স্থায়ী বিকৃতিই হলো অস্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ।
অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ (Inelastic Collision)
পদার্থবিজ্ঞানে অস্থিতিস্থাপকতার সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সংঘর্ষের (Collision) ক্ষেত্রে।
সংজ্ঞা
যে সংঘর্ষে বস্তুর ভরবেগ (Momentum) সংরক্ষিত থাকে কিন্তু গতিশক্তি (Kinetic Energy) সংরক্ষিত থাকে না, তাকে অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ বলে। এই ধরনের সংঘর্ষে গতিশক্তির একটি অংশ তাপ, শব্দ বা বস্তুর আকার পরিবর্তনের কাজে ব্যয় হয়ে যায়।
পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ (Perfectly Inelastic Collision)
যখন সংঘর্ষের পর দুটি বস্তু একে অপরের সাথে আটকে যায় এবং একটি মিলিত বস্তু হিসেবে একই বেগে চলতে থাকে, তখন তাকে পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ বলে।
- উদাহরণ: একটি চলন্ত ট্রাকের সাথে একটি ছোট গাড়ি ধাক্কা খেয়ে আটকে গিয়ে একই সাথে ঘষটে যাওয়া। অথবা, বন্দুকের গুলি একটি কাঠের ব্লকে বিদ্ধ হয়ে ব্লকের ভেতরেই থেকে যাওয়া।
গাণিতিক সূত্র (পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে):
(এখানে v হলো মিলিত বস্তুর শেষ বেগ)
স্থিতিস্থাপক বনাম অস্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের পার্থক্য
| বৈশিষ্ট্য | স্থিতিস্থাপক (Elastic) | অস্থিতিস্থাপক (Inelastic) |
|---|---|---|
| গতিশক্তি | সংরক্ষিত থাকে (ধ্রুবক)। | সংরক্ষিত থাকে না (কমে যায়)। |
| ভরবেগ | সংরক্ষিত থাকে। | সংরক্ষিত থাকে। |
| আকৃতি পরিবর্তন | সংঘর্ষের পর আকার সাধারণত বিকৃত হয় না। | সংঘর্ষের পর আকার বিকৃত হতে পারে। |
| শক্তির রূপান্তর | যান্ত্রিক শক্তি তাপ বা শব্দে পরিণত হয় না। | গতিশক্তি তাপ, শব্দ বা আলোতে রূপান্তরিত হয়। |
| অবস্থান গুণাঙ্ক (e) | e = 1 | 0 ≤ e < 1 (পূর্ণ অস্থিতিস্থাপক হলে e=0)। |
বাস্তব জীবনে অস্থিতিস্থাপকতার গুরুত্ব
যদিও মনে হতে পারে স্থিতিস্থাপকতাই ভালো, কিন্তু অস্থিতিস্থাপকতারও বিশাল গুরুত্ব রয়েছে:
- গাড়ির ক্রাম্পল জোন (Crumple Zones): আধুনিক গাড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে দুর্ঘটনার সময় গাড়ির সামনের অংশটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এটি সংঘর্ষের গতিশক্তি শোষণ করে নেয়, ফলে যাত্রীর ওপর আঘাত কম লাগে।
- ধাতু গঠন (Metal Forming): কামারশালায় বা কারখানায় লোহাকে পিটিয়ে যে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়, তা ধাতুর অস্থিতিস্থাপক বা প্লাস্টিক ধর্মের কারণেই সম্ভব হয়।
- মাটির কাজ: মাটির তৈরি আসবাবপত্র বা শিল্পকর্ম তৈরিতে মাটির অস্থিতিস্থাপক ধর্ম কাজে লাগানো হয়।
সারাংশ: স্থিতিস্থাপকতা চায় আগের অবস্থায় ফিরে যেতে, আর অস্থিতিস্থাপকতা চায় পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে নতুন আকার ধারণ করতে বা শক্তি শোষণ করে নিতে। এই দুই ধর্মের ভারসাম্যই প্রকৌশলবিদ্যাকে সচল রেখেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের নিবন্ধগুলিতে মন্তব্য করার সময় দয়া করে শ্রদ্ধাশীল এবং গঠনমূলক হন। অনুপযুক্ত, আপত্তিকর, বা অফ-টপিক মন্তব্য মুছে ফেলা হবে। আসুন ABC আইডিয়াল স্কুলের সকল পাঠকদের জন্য একটি ইতিবাচক এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ বজায় রাখি। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ!