অমর একুশে রচনা ১০০০ শব্দ
অমর একুশে
ভূমিকা :
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি অমর , অক্ষয় এবং স্ব - মহিমায় প্রোজ্জ্বল একটি দিন । অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনার এক উর্বর উৎস । তেরো কোটি বাঙালির কাছে এ দিনটি অবিস্মরণীয় । ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের সুমহান স্মৃতির মালায় গাঁথা এ দিনটিকে বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে । রক্ত - রঞ্জিত এ একুশে ফেব্রুয়ারিতেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলার কিছু তরুণ তাদের তাজা প্রাণ অকাতরে আত্মোৎসর্গ করে বাংলার ইতিহাসে লাভ করেছে অমরত্ব । এ চিহ্নিত দিনটি বাঙালি জাতীয়তাবোধের নবজন্মের দিন । এ দিনটির সাথে নির্যাতিত , শোষিত ও বঞ্চিত বাঙালি জাতির এক বিষাদবিধুর ইতিহাস জড়িত ।
পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র :
একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস খুবই বেদনাবহ । বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৫২ - এর ফেব্রুয়ারি অথবা পলাশ রাঙা ফাল্গুন এক ক্রান্তিলগ্ন । তখন পাকিস্তানি শাসনামল । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হতেই পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকচক্রের পরিকল্পিত শোষণ ও বঞ্ছনায় এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল ক্ষুব্ধ । তদুপরি এদেশের চিরাচরিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত হানতে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঘোষণা দেয় ' উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । এর মূলে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষা মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্য । তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর এটা ছিল বাঙালিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ।
ভাষা আন্দোলন :
ভাষাপ্রেমী বাঙালিরা প্রতিরোধ আন্দোলনের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠীর অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি । এদেশের দামাল ছেলেরা এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল । রাজরোষ ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াল । তারা গড়ে তুলল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ । মিটিং , মিছিল আর শ্লোগানে মুখরিত করে তুলল তদানীত্তন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ - বাতাস । দুর্বার ভাষা আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ল শাসকগোষ্ঠী , জারি হলো ১৪৪ ধারা । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তরুণদের দুর্জয় প্রতিবাদ মিছিলে ১৪৪ ধারার প্রতিরোধ ব্যূহ চুরমার হয়ে গেল । আকাশে - বাতাসে ধ্বনিত হলো ' রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ' । উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বসল ছাত্র - জনতার মিছিলে । রাষ্ট্রভাষা বাংলার ন্যায্য দাবির পবিত্র মিছিল রঞ্জিত হলো বুকের বুধিরে । সালাম , বরকত , রফিক , জব্বার , শফিউর প্রমুখ তরুণের বক্ষ - শোণিতে ঢাকার রাজপথে আঁকা হলো রক্তের আল্পনা । অবশেষে রাজশক্তি মেনে নিল বাঙালির প্রাণের দাবি । বাংলা হলো অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ।
জাতীয় জীবনে একুশের প্রভাব বা তাৎপর্য :
জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য খুবই অর্থবহ । একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একটি দিনই নয় । এখান থেকেই বাঙালির জাতীয় জীবনে যে গতিশীল চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল , তাই একদা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার , স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করেছিল । দিনের পর দিন বছরের পর বছর শোষিত , বঞ্চিত ও পোড়খাওয়া বাঙালি জাতি ইস্পাতকঠিন দৃপ্ত শপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল । একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিল । একশে ফেব্রুয়ারির প্রভাবেই বাঙালি জাতি এক জাগ্রত জাতি হিসেবে চিহ্নিত । এ জাগ্রত মানবশক্তিই বাংলাদেশের অন্যতম সক্রিয় সম্পদ । একুশের প্রেরণায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মেহনতি মানুষ তাদের নিরলস শ্রম ও দেহ - নিঃসৃত প্রতিটি স্বেদবিন্দুর বিনিময়ে স্বক্রীয় মহিমায় বিভূষিত এক সোনার বাংলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল । একুশ বাঙালির জাতীয়তা , স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক অকাট্য দলিল ।
বায়ান্ন থেকে একাত্তর :
মূলত বায়ান্ন সালে বাঙালি জাতীয়তাবোধের যে সস্ফূরণ ঘটেছিল তা - ই ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে । ভাষাকে কেন্দ্র করেই গোটা জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল । একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই '৬৯ সালে বাঙালিরা অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে । ১৯৭০ সালে নির্বাচনি বিজয়ের পরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে বাঙালির ওপর চালানো হলো নির্মম হত্যাকাণ্ড তখন এদেশের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াল । দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর বাংলার মানুষ লাভ করল স্বাধীনতার সোনালি সূর্য । বায়ান্ন সালে যে চেতনার স্ফূরণ ঘটেছিল তারই পরিণতি ঘটে একাত্তরে । সেজন্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলন প্রাণশক্তি হিসেবে চিহ্নিত ।
একুশ আমার অহঙ্কার :
বাঙালি জাতির যতগুলো অহঙ্কারের অনুষঙ্গ আছে তার মধ্যে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যতম । পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্যে অকাতর আত্মদানের নজির একমাত্র বাঙালিরই রয়েছে । বাঙালি জাতি ভাষার জন্যে আত্মদানের যে অহঙ্কার অর্জন করেছে তার প্রতি বিশ্ববাসী সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার মধ্যদিয়ে । শিকাগোতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যে আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১ মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে উদযাপিত হয় । বাংলার মানুষের মাতৃভাষাপ্রীতির স্বীকৃতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে । এটা আমাদের জন্যে অবশ্যই অহঙ্কার ও গর্বের বিষয় । একুশ আমাদের দিয়েছে আত্মপরিচয়ের সম্মান , অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবনদানের প্রেরণা । আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে একুশের কল্যাণেই ।
উপসংহার :
একুশ দুর্জয় ও দুর্বার বাঙালি জাতির এক কালজয়ী অমর ও অক্ষয় কীর্তির স্মৃতিময় প্রামাণ্য সনদ । একুশের নির্যাসকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে । জীবনের সর্বস্তরে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদেরকে মনে - প্রাণে খাঁটি বাঙালি বলে প্রমাণ করতে হবে । কথনে , লিখনে , চিত্তনে ও পঠনে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করাই একুশের মূল দাবি ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের নিবন্ধগুলিতে মন্তব্য করার সময় দয়া করে শ্রদ্ধাশীল এবং গঠনমূলক হন। অনুপযুক্ত, আপত্তিকর, বা অফ-টপিক মন্তব্য মুছে ফেলা হবে। আসুন ABC আইডিয়াল স্কুলের সকল পাঠকদের জন্য একটি ইতিবাচক এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ বজায় রাখি। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ!