জে জে থমসন: ইলেকট্রন আবিষ্কার, পারমাণবিক তত্ত্ব এবং জীবনী

আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, যে পরমাণুকে একসময় অবিভাজ্য ভাবা হতো, তার ভেতরের প্রথম কণাটি কে আবিষ্কার করেছিলেন? তিনি ছিলেন স্যার জোসেফ জন থমসন, যিনি জে. জে. থমসন নামেই বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তিনি কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন একজন যুগস্রষ্টা যিনি ১৮৯৭ সালে ইলেকট্রন আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের গতিপথ চিরতরে পাল্টে দেন।

জে জে থমসন: ইলেকট্রনের আবিষ্কার, পারমাণবিক তত্ত্ব এবং জীবনী

আসুন, আজ আমরা এই মহান বিজ্ঞানীর শৈশব থেকে শুরু করে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোমাঞ্চকর পথচলা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন

জোসেফ জন থমসনের জন্ম ১৮৫৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। তার বাবা ছিলেন একজন বই বিক্রেতা এবং তিনি চাইতেন ছেলে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু থমসনের ঝোঁক ছিল গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি।

তার শিক্ষাজীবনের শুরুটা ছিল চমকপ্রদ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ওয়েন্স কলেজে (Owens College) ভর্তি হন, যা বর্তমানে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত। এটি ছিল সেই সময়ের তুলনায় এক ব্যতিক্রমী ঘটনা।

১৮৭৬ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজে গণিত পড়ার জন্য স্কলারশিপ পান। সেখান থেকেই তার অ্যাকাডেমিক জীবনের ভিত্তি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরি ও গবেষণার স্বর্ণযুগ

১৮৮৪ সালটি ছিল থমসনের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির প্রধান (Cavendish Professor) হিসেবে নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে এই ল্যাবরেটরিটি খুব দ্রুত বিশ্বের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়।

যুগান্তকারী 'ইলেকট্রন' আবিষ্কার (১৮৯৭)

১৯ শতকের শেষভাগে বিজ্ঞানীরা 'ক্যাথোড রে' (Cathode Ray) নামক এক রহস্যময় রশ্মি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জে. জে. থমসন এই রশ্মিগুলোর আসল প্রকৃতি উদঘাটনের জন্য একটি brilliantly designed পরীক্ষা চালান।

  • তিনি প্রমাণ করেন যে, এই রশ্মিগুলো বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা নিশ্চিত করে যে এগুলো ঋণাত্মক চার্জযুক্ত কণা।
  • সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি এই কণাগুলোর ভর-থেকে-চার্জের অনুপাত (e/m) পরিমাপ করেন।
  • তিনি দেখতে পান যে, এই কণাগুলো সবচেয়ে হালকা পরিচিত পরমাণু (হাইড্রোজেন) থেকেও প্রায় ১,৮০০ গুণ বেশি হালকা।
ইলেকট্রন' আবিষ্কার

এই পরীক্ষার ভিত্তিতে থমসন ১৮৯৭ সালে এই বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, এই কণাগুলো পরমাণুর চেয়েও ক্ষুদ্র এবং এগুলোই পরমাণুর মৌলিক উপাদান। তিনি প্রাথমিকভাবে এগুলোর নাম দেন 'করপাসল' (corpuscles), যা আজ বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রন (Electron) নামে পরিচিত।

এই আবিষ্কার তৎকালীন ডাল্টনের "পরমাণু অবিভাজ্য" তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে এবং পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

পরমাণুর 'প্লাম পুডিং মডেল' (১৯০৪)

ইলেকট্রন আবিষ্কারের পর থমসনের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসে—পরমাণু সামগ্রিকভাবে চার্জ-নিরপেক্ষ কেন? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ১৯০৪ সালে পরমাণুর একটি মডেল প্রস্তাব করেন, যা "প্লাম পুডিং মডেল" (Plum Pudding Model) নামে বিখ্যাত হয়।

পরমাণুর 'প্লাম পুডিং মডেল' (১৯০৪)

এই মডেল অনুসারে, পরমাণু হলো একটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত সুষম গোলক (পুডিং বা কেক), যার মধ্যে ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ইলেকট্রনগুলো (প্লাম বা কিসমিসের মতো) গেঁথে থাকে। যদিও এই মডেলটি পরে তারই ছাত্র আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের পরীক্ষার মাধ্যমে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল, তবুও এটিই ছিল পরমাণুর গঠন সম্পর্কে প্রথম যৌক্তিক এবং বৈজ্ঞানিক মডেল।

আইসোটোপের প্রথম প্রমাণ

থমসনের অবদান শুধু ইলেকট্রনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ধনাত্মক চার্জযুক্ত রশ্মি (Positive Rays) নিয়ে কাজ করার সময় ১৯১২ সালে নিয়ন গ্যাসকে একটি চৌম্বক ও বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চালনা করেন। তিনি দেখতে পান যে রশ্মিটি দুটি ভিন্ন পথে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে।

এটি প্রমাণ করে যে, নিয়নের দুটি ভিন্ন পারমাণবিক ভরের পরমাণু রয়েছে (নিয়ন-২০ এবং নিয়ন-২২)। এটি ছিল কোনো স্থিতিশীল মৌলের আইসোটোপ বা সমস্থানিক আবিষ্কারের প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তার এই গবেষণাই আধুনিক 'মাস স্পেকট্রোমিটার' (Mass Spectrometer) যন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।

সম্মাননা, শিক্ষকতা ও শেষ জীবন

জে. জে. থমসনের জীবন ছিল কৃতিত্বে পরিপূর্ণ।

নোবেল পুরস্কার (১৯০৬): গ্যাসের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহন বিষয়ে তার যুগান্তকারী তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক গবেষণার জন্য তাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

নাইটহুড: ১৯০৮ সালে তাকে 'স্যার' (Knight) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

মহান শিক্ষক: থমসন কেবল একজন সেরা বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষক। তার অধীনে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে কাজ করা আটজন গবেষক পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যাদের মধ্যে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, ফ্রান্সিস অ্যাস্টন অন্যতম।

একটি মজার তথ্য: জে. জে. থমসন ইলেকট্রনকে 'কণা' হিসেবে প্রমাণ করে নোবেল পেয়েছিলেন। ঠিক এর কয়েক দশক পর, তারই পুত্র জি. পি. থমসন (George Paget Thomson) ইলেকট্রনের 'তরঙ্গ' ধর্ম প্রমাণ করে ১৯৩৭ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

১৯১৮ সালে থমসন কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু সেই পদে আসীন ছিলেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৯৪০ সালের ৩০ আগস্ট ৮৩ বছর বয়সে কেমব্রিজে এই মহান বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং তার ছাত্র আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের পাশেই সমাহিত করা হয়।

স্যার জে. জে. থমসন ছিলেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম জনক। তার একটি আবিষ্কার (ইলেকট্রন) পরমাণুর রহস্যময় জগতের দরজা খুলে দিয়েছিল, যা ছাড়া আজকের কোয়ান্টাম মেকানিক্স, রসায়ন বা আধুনিক ইলেকট্রনিক্স—কোনোটিই সম্ভব হতো না।