রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মৃণালিনী দেবী: এক সংক্ষিপ্ত দাম্পত্য জীবন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মৃণালিনী দেবী

১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন মৃণালিনী দেবী রায়চৌধুরীর সঙ্গে। এই বিবাহ ছিল একদিকে যেমন সময়ের প্রচলিত রীতির প্রতিফলন, তেমনই রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী জীবনে ফেলেছিল এক গভীর প্রভাব। 

বিবাহ ও পরিচয়

বিয়ের সময় কনে মৃণালিনী দেবীর বয়স ছিল মাত্র নয় (৯) বছর (মতান্তরে ৯ বছর ৯ মাস বা ১০ বছর), এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ছিল বাইশ (২২) বছর। মৃণালিনী দেবীর পৈতৃক নাম ছিল ভবতারিণী। তিনি ছিলেন ঠাকুর-বাড়ির এক কর্মচারী, যশোহরের বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা। ঠাকুরবাড়িতে ভবতারিণী নামটি প্রচলিত না থাকায়, রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন মৃণালিনী। কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল কবির প্রিয় নাম 'নলিনী'রই প্রতিশব্দ।

রবীন্দ্রনাথের ভাতিজি ইন্দিরা দেবীর সাথে কবি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন ফুলতলায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছায় জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনে এই বিবাহটি ব্রাহ্মমতে অনুষ্ঠিত হয়।

দাম্পত্য জীবন ও ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবীর দাম্পত্য জীবন ছিল ১৬ থেকে ১৯ বছরের মতো সংক্ষিপ্ত। এই সময়ে তাঁদের পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়: মাধুরীলতা (বেলা)রথীন্দ্রনাথ**, রেণুকা, মীরা এবং শমীন্দ্রনাথ

শিক্ষাদীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিয়ের এক মাস পর মৃণালিনীকে রবীন্দ্রনাথের বউদি জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম (বর্তমানে বিশ্বভারতী) প্রতিষ্ঠা হলে, মৃণালিনী দেবীও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি কঠোরভাবে আশ্রমের দায়িত্ব পালন করতেন, এমনকি বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে নিজের গহনাও ত্যাগ করতে পিছপা হননি। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ জোগাতে মৃণালিনী দেবীর বহু গহনা বিক্রয় করা হয়েছিল।

তিনি ছিলেন একজন নীরব ও গভীর ব্যক্তিত্বময়ী নারী, যিনি সর্বদা তাঁর স্বামীর সৃষ্টিশীল কাজে এবং বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক উদ্যোগে পাশে থেকেছেন। শান্তিনিকেতনের শুরুর দিনগুলিতে অন্যান্য ছাত্রদের সাথে নিজের সন্তান রথীন্দ্রনাথকেও নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন।

অকাল প্রয়াণ

১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী মারা যান। তাঁর অকাল প্রয়াণ কবিকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর সন্তানদের বড় করার এবং শান্তিনিকেতনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার গুরুভার একা হাতে বহন করেন। এই শোক কবির অনেক সৃষ্টিতেও প্রতিফলিত হয়েছে।

তাঁর এই সংক্ষিপ্ত জীবন রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করে এবং কবির কর্ম ও সৃষ্টির মধ্যেও মৃণালিনী দেবীর স্মৃতি ও প্রভাব অমলিন হয়ে থাকে।

ভিডিও দেখুন