মহান বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব ১০০০ শব্দ

মহান বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব

ভূমিকা:

১৬ই ডিসেম্বর, বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জন—মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল, এবং অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। দিনটি একদিকে যেমন আনন্দের, তেমনি অন্যদিকে লক্ষ শহীদের স্মরণে বেদনারও। এই বিজয় শুধু একটি ভূখণ্ডের মুক্তি নয়, এটি ছিল বাঙালি জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক মহিমান্বিত বিজয়। বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট সুদূরপ্রসারী এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম, যা আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতি স্তরে মিশে আছে।

মহান বিজয় দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। এর বীজ নিহিত ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের শিকার হয়। ভৌগোলিক দূরত্ব, ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির চরম বৈষম্য বাঙালি জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে পরিচালিত করে।

ভাষা আন্দোলন (১৯৫২): ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সোপান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাঙালির মুখের ভাষা, বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে, তখন ছাত্র-জনতা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হয়। এই আন্দোলন বাঙালিকে শিখিয়েছিল নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে হবে।

বৈষম্য ও শোষণ: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক—সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হতো। দেশের মোট সম্পদের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতো, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার শিকার। এই শোষণ ও বৈষম্য বাঙালি সমাজে গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি করে।

বঙ্গবন্ধু ও ছয়-দফা আন্দোলন (১৯৬৬): জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা দাবি পেশ করেন। এই ছয়-দফা ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি, যা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দেয়। এটি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ছিল চরম ভীতির কারণ।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান: ছয়-দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এই অভ্যুত্থান প্রমাণ করে, বাঙালি জাতি এখন আর পরাধীনতা মেনে নেবে না।

সত্তরের নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি: ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং জাতীয় পরিষদেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করে।

৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু এক কালজয়ী ভাষণ দেন, যেখানে তিনি কার্যত স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা— "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"—মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র গেঁথে দেয়।

২৫শে মার্চের কালরাত্রি ও স্বাধীনতার ঘোষণা: আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শুরু করে ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড—অপারেশন সার্চলাইট। এই পটভূমিতেই ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপরই শুরু হয় দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধ ও চূড়ান্ত বিজয় (১৯৭১): বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। ভারত সরকার এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনী হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে এই জনযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ শহীদ হন, সম্ভ্রম হারান অসংখ্য মা-বোন, এবং এক কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। অবশেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর কাছে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

মহান বিজয় দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

১৬ই ডিসেম্বর শুধু একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এই দিবসের গুরুত্ব বহুমাত্রিক:

সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়: বিজয় দিবসের প্রধান গুরুত্ব হলো একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ২৪ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পায়। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় লাল-সবুজের পতাকা, যা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা লাভ: ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পায়। বিজয় দিবস সেই চেতনার চূড়ান্ত প্রকাশ, যা বাঙালিকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করিয়ে দেয়।

আত্মত্যাগের মহিমা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: এই বিজয় অর্জিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মদান, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং অগণিত মানুষের কষ্টের ফসল এই বিজয়। বিজয় দিবস তাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এবং তাদের ঋণ স্বীকার করার দিন। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার মূল্য কত রক্ত ও ত্যাগের সমান।

গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি: মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চারটি মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা (অসাম্প্রদায়িকতা) এবং জাতীয়তাবাদ। বিজয় দিবস এই নীতিগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষকে একত্রে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে উদ্বুদ্ধ করে।

আত্মমর্যাদা ও বিশ্বব্যাপী পরিচিতি: বিজয় বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছে আত্মমর্যাদা এবং বিশ্বে বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি। পৃথিবীর খুব কম জাতিই এতো দামে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। এই বিজয় পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি: পাকিস্তানের শাসনামলে বাঙালি জাতি অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। বিজয় দিবস সেই শোষণ থেকে মুক্তি এবং একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের পথ উন্মোচন করে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে, যার মূল প্রেরণা এই বিজয়।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা: বিজয় দিবস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস। এই দিনটি তাদের কাছে তুলে ধরে, কীভাবে ঐক্য, সাহস ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। নতুন প্রজন্ম এই দিন থেকে দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধের শিক্ষা লাভ করে।

বিজয় দিবসের উদযাপন:

প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে সরকারি ছুটি পালিত হয়। এই দিনটি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং একই সাথে গভীর শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করা হয়।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা: দিনের শুরুতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং সর্বস্তরের জনগণ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।

বিজয় কুচকাওয়াজ: ঢাকা প্যারেড গ্রাউন্ডে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণামূলক আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

আলো সজ্জা: সরকারি-বেসরকারি ভবন, সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে জাতীয় পতাকা ও বর্ণিল আলোয় সজ্জিত করা হয়।

উপসংহার:

মহান বিজয় দিবস বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের দিন। এটি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা কোনো করুণার দান নয়, এটি লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এক গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ। বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট একদিকে যেমন কষ্টের ও ত্যাগের, তেমনি এর গুরুত্ব আমাদের জাতীয় জীবনের ভিত্তিভূমি। এই দিনকে সার্থক করতে হলে কেবল উৎসব নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি উন্নত সোনার বাংলা বিনির্মাণে সকলকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। বিজয় দিবসের শপথ হোক, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।