স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বর্তমান বাস্তবতা রচনা ১০০০ শব্দ

স্বাধীনতার স্বপ্ন ও বর্তমান বাস্তবতা

ভূমিকা:

স্বাধীনতা কেবল একটি শব্দ নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্বের পরিচয়। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সাল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের এক মরণপণ লড়াই। কিন্তু সেই লড়াইয়ের মূল উদ্দেশ্য কি কেবল একটি ভূখণ্ড বা একটি নিজস্ব পতাকা অর্জন ছিল? নাকি এর পেছনে ছিল একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন? স্বাধীনতার দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে আজ যখন আমরা পেছনে ফিরে তাকাই, তখন মনের কোণে প্রশ্ন জাগে—১৯৭১-এর সেই সোনালী স্বপ্ন আর ২০২৪-এর বাস্তবতার মধ্যে ব্যবধান কতটুকু? এই প্রবন্ধে স্বাধীনতার মূল স্বপ্ন এবং বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো।

স্বাধীনতার স্বপ্ন: কী চেয়েছিল বাংলাদেশ?

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি ছিল ‘মুক্তি’। এই মুক্তি কেবল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি ছিল না, এটি ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ থেকে মুক্তি।

১. বৈষম্যহীন সমাজ গঠন: স্বাধীনতার প্রধান স্বপ্ন ছিল এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে ধনী-দরিদ্রের আকাশচুম্বী ব্যবধান থাকবে না। পাকিস্তানি শাসনামলে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল, তা দূর করে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা ছিল অন্যতম লক্ষ্য।

২. গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা: একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার এবং মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। শাসকের জবাবদিহিতা থাকবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

৩. ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা: ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের পক্ষাবলম্বন করবে না এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে।

৪. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: ‘সোনার বাংলা’ গড়ার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, তার মূলে ছিল কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা। যেন বাংলাদেশকে আর কখনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়।

৫. সামাজিক ন্যায়বিচার: শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা এবং সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

বর্তমান বাস্তবতা: প্রাপ্তির উজ্জ্বল দিক

স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর বাংলাদেশ আজ বিশ্বমঞ্চে একটি উদীয়মান শক্তি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ঈর্ষণীয় এবং গর্ব করার মতো। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চোখে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: একসময় যে দেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করা হতো, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার হ্রাসে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বড় প্রমাণ।

অবকাঠামগত উন্নয়ন: নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের সক্ষমতা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। এ ছাড়া মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগাপ্রজেক্টগুলো দেশের যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

সামাজিক সূচকে অগ্রগতি: মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থায় উন্নতিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। শিক্ষার হার বেড়েছে এবং প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জিত হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়ন: পোশাক শিল্পে লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান এবং প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ ও রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সাফল্য নির্দেশ করে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ: তথ্য ও প্রযুক্তির প্রসারে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে গেছে। ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স এবং সরকারি সেবা ডিজিটালাইজেশনের ফলে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে।

বর্তমান বাস্তবতা: অপ্রাপ্তি ও চ্যালেঞ্জসমূহ

উন্নয়নের এই চকচকে মোড়কের আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু রূঢ় বাস্তবতা। স্বাধীনতার যে মূল চেতনা—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—তা কি আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন কিছু ক্ষত তৈরি হয়েছে যা স্বাধীনতার স্বপ্নকে ম্লান করে দিচ্ছে।

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য: যদিও দেশের জিডিপি বেড়েছে, কিন্তু সম্পদের সুষম বন্টন হয়নি। ধনী আরও ধনী হয়েছে, আর দরিদ্ররা ধুঁকছে। আয়ের বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। একদিকে আকাশচুম্বী অট্টালিকা, অন্যদিকে বস্তিবাসীর মানবেতর জীবন—এই দ্বৈততা স্বাধীনতার স্বপ্নের পরিপন্থী।

২. দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব: দুর্নীতির করাল গ্রাস দেশের প্রতিটি সেক্টরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সরকারি সেবা পেতে ঘুষ বা স্বজনপ্রীতি যেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক লুটপাট, অর্থ পাচার এবং ঋণখেলাপির সংস্কৃতি অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। আইনের শাসন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি করেছে।

৩. গণতন্ত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: স্বাধীনতার অন্যতম স্তম্ভ ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন এবং বিরোধী মত দমনের প্রবণতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ রয়েছে।

৪. মূল্যবোধের অবক্ষয় ও কিশোর অপরাধ: অবকাঠামোগত উন্নতির সাথে সাথে আমাদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। সমাজে অসহিষ্ণুতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, এবং কিশোর গ্যাং কালচারের বিস্তার ঘটছে। মাদকের বিস্তার যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

৫. বেকারত্ব ও মেধা পাচার: শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে হতাশাগ্রস্ত তরুণরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধা পাচার দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত।

৬. পরিবেশ বিপর্যয়: অপরিকল্পিত নগরায়ন, নদী দখল ও দূষণ, এবং বনভূমি উজাড় করার ফলে পরিবেশ আজ হুমকির মুখে। ঢাকার বায়ুদূষণ ও যানজট বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে, যা সুস্থ জীবনের অন্তরায়।

স্বপ্ন ও বাস্তবতার মেলবন্ধন: উত্তরণের উপায়

স্বপ্ন ও বাস্তবতার এই ব্যবধান ঘুচাতে হলে আমাদের কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে তাকালে হবে না, বরং মানবিক ও নৈতিক উন্নয়নের দিকেও নজর দিতে হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন এবং বিচার বিভাগের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে। আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে যেন অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, তাকে বিচারের আওতায় আনা যায়।

মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থান: কেবল সনদসর্বস্ব শিক্ষা নয়, বরং কারিগরি ও নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতে হবে এবং উদ্যোক্তা তৈরীর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

রাজনৈতিক সহনশীলতা: ক্ষমতার পালাবদল এবং রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকবেই, কিন্তু তা যেন সংঘাতের দিকে না যায়। জাতীয় স্বার্থে সকল দলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

বৈষম্য হ্রাস: কর ব্যবস্থায় সংস্কার এনে এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও শক্তিশালী করে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমাতে হবে।

উপসংহার:

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমাদের অর্জন কম নয়, কিন্তু স্বপ্নের গন্তব্য আরও বহুদূর। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা এই দেশটিকে কেবল ইট-পাথরের দালান দিয়ে বিচার করা যাবে না। স্বাধীনতার প্রকৃত সার্থকতা তখনই আসবে, যখন দেশের একজন কৃষক, শ্রমিক বা দিনমজুরও মনে করবেন যে এই রাষ্ট্রটি তার, এখানে তার অধিকার সুরক্ষিত এবং তিনি মর্যাদার সাথে বাঁচতে পারছেন।

বর্তমান বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। একাত্তরের যুদ্ধ ছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে, আর এখনকার যুদ্ধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং অনাচারের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই আমরা গর্ব করে বলতে পারব—আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার নাগরিক। নতুবা, স্বাধীনতা কেবল একটি ক্যালেন্ডারের তারিখে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার এই দূরত্ব কমিয়ে আনাই হোক আমাদের আগামীর শপথ।