বাংলা ভাষার পরিচয় , বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব | বাংলা ব্যাকরণ

বাংলা ভাষার পরিচয় , বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলাে ভাষা । মনের ভাব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশের তাগিদ থেকেই ভাষার সৃষ্টি । বাগযন্ত্র দ্বারা উচ্চারিত অর্থবােধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে ।

ড . মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে , ' মনুষ্য জাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনি সকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে , তাহার নাম ভাষা ।

ড . সুকুমার সেন বলেছেন , ‘ মনের ভাব প্রকাশ করার নিমিত্ত বিভিন্ন জাতির বা সমাজের সকল সভ্যের বােধগম্য বাক্যসমূহের সমষ্টিকে সেই জাতির ভাষা বলে ।

ড . মুহম্মদ আবদুল হাই - এর মতে , ' এক এক সমাজের সকল মানুষের অর্থবােধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা ।

অর্থাৎ , যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তা - ই ভাষা ।

বাংলা ভাষার পরিচয়

বাঙালি সম্প্রদায় বাগযন্ত্র সৃষ্ট যে ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা একে অপরের কাছে মনের ভাব প্রকাশ করে তাই বাংলা ভাষা । বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা । এ ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা । বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ , বিহার , উড়িষ্যা , ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের মুখ্য ভাষা বাংলা । মিয়ানমারের আরাকানেও বাংলা ভাষা প্রচলিত । এ ছাড়া ইউরােপ , আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলে । সম্প্রতি সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে । বিভিন্ন দেশের রেডিও - টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে বাংলা অনুষ্ঠান , এ ছাড়া প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ভাষায় নানারকম পত্রিকা । এভাবে বাংলা ক্রমেই বৈশ্বিক ভাষায় পরিণত হতে চলেছে । বর্তমান বিশ্বে বাংলাভাষী জনগােষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ত্রিশ কোটি এবং ভাষা ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে এ ভাষার অবস্থান চতুর্থ । বিশ্বের অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষা একটি বিশেষ দিক থেকে মর্যাদা দাবি করতে পারে । আর তা হলাে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি এ ভাষার মর্যাদা আদায় করেছে ।

আত্মমর্যাদাশীল ও বিশ্ববিস্তারি বাংলা ভাষা সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস । বিশ্বের যাবতীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে হাতেগােনা কয়েকটি ভাষাগােষ্ঠী থেকে । তাদের মধ্যে একটি হলাে ইন্দো - ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠী । এই ভাষাগােষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেকগুলাে ভাষা । আর ওই ভাষাগুলােই বর্তমান বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচলিত ভাষা । বাংলা ভাষাও ইন্দো - ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীরই অংশ । এখন থেকে প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে এ অঞ্চলে ইন্দো - ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা ।

জনবিস্তৃতির ফলে ইউরােপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লােকজন যে যার সুবিধেমতাে ছড়িয়ে - ছিটিয়ে নিজেদের স্থায়ী আবাস নির্ধারণ করতে থাকে । তেমনি ইন্দো - ইউরােপীয় ভাষাগােষ্ঠীর একদল মানুষ পাকিস্তানের উত্তর - পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে , যাদের ভাষা ছিল আর্য । ভারতীয় জাতিসত্তার দিক থেকে আর্যরা বহিরাগত । তবুও আভিজাত্য ও কৌলিন্যে তারা ভারতীয়দের শীর্ষেই অবস্থান করত । স্থানীয় অনার্য অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অধিগত করে আর্যরা তাদের স্বভাষারই ( আর্যের ) আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । কালক্রমে সে আধিপত্য ক্ষুদ্র হতে থাকে । কারণ ভাষাকে কখনাে শৃঙ্খলিত করে রাখা যায় না । জলবায়ুগত প্রভাব ও অনার্যদের অবাধ প্রয়ােগের কারণে আর্য ভাষায় দেখা দিল মিশ্রণ । এই মিশ্রণের ফলে ভাষা তার স্বাভাবিক মান হারাতে লাগল । প্রয়ােজন দেখা দিল ভাষা শাসন বা সংস্কারের ।

খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে শুরু হলাে ভাষা শাসনের কাজ । উদ্দেশ্য সর্বজনগ্রাহ্য একটি মানসম্মত ভাষার প্রচলন করা । অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে পাণিনি ( পৃথিবীর অন্যতম আদি ব্যাকরণবিদ ) তার ' অষ্টাধ্যায়ী ’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ভাষাকে সংস্কার করে একটি মান্য ও পরিশীলিত রূপ দেন । এই সংস্কারজাত ভাষার নতুন নামই সংস্কৃত ভাষা । যেহেতু ভাষা হলাে প্রবহমান নদীর মতাে তাই এই সংস্কারজাত সংস্কৃত ভাষা কেবল উচ্চবিত্ত বা সম্রান্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না । মানুষের চিরায়ত মুখের ভাষা ভারতে নানা অঞলে নানা রূপ নিয়ে বিস্তার লাভ করতে লাগল , যার নাম ‘ প্রাকৃত ' অর্থাৎ প্রাকৃতজনের মুখের ভাষা বা সাধারণ জনগণের কথ্য ও বােধ্য ভাষা । পরে এই ‘ প্রাকৃত ভাষা ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে ও উচ্চারণের ভিন্নতায় নানা রূপ ধারণ করতে থাকে । যেমন মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত , অর্ধমাগধি প্রাকৃত , মাগধি প্রাকৃত , গৌড়ি প্রাকৃত ইত্যাদি । গৌড়ি প্রাকৃত থেকেই অপভ্রংশের ( বিকৃতের ) মাধ্যমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি । বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন 'চর্যাপদে ' প্রাচীন বাংলা ভাষার পরিচয় পাওয়া যায় ।

ক্রমান্বয়ে মধ্যযুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন , বৈষ্ণব পদাবলি , অনুবাদ সাহিত্য , মঙ্গলকাব্য , রােমান্টিক প্রণয়ােপাখ্যান ও লােকসাহিত্যের ( মৌলিক ঐতিহ্যের ) ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা ক্রমেই বিকশিত হয় । উনিশ শতকে পত্র - পত্রিকা ও গ্রন্থ মুদ্রণের ভেতর দিয়ে বাংলা ক্রমেই একটি সমৃদ্ধ ভাষার রূপ লাভ করতে থাকে ।

বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য

ভাষমাত্রেই কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । যেমন—

  • ভাষা বাগযন্ত্র নিঃসৃত ধ্বনির সাহায্যে গঠিত।
  • ভাষার ধ্বনিসমূহের অর্থবােধকতা আছে।
  • ভাষা একটি বিশেষ জনগােষ্ঠীর কাছে অর্থবহ ও প্রচলিতভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল ও গতিশীল ।

এই বৈশিষ্ট্যগুলাে পৃথিবীর সকল ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য । বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও । তবে প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে । এই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে ভাষার স্বতন্ত্র রূপটি প্রকাশ পায় । বাংলা ভাষারীতি ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য , শব্দ গঠন , শব্দভাণ্ডার এবং বাক্যরীতির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে । কথ্য , লেখ্য , সাধু , চলিত ছাড়াও নানান উপভাষা রূপও লক্ষ করা যায় এ ভাষায় । এখানে বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখানাে হলাে:-

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১. বাংলা ভাষার বর্ণমালায় ১১ টি স্বরবর্ণ ও ৩৯ টি ব্যঞ্জনবর্ণ থাকলেও মৌলিক স্বরধ্বনি ৭ টি ও ব্যঞ্জনধ্বনি মূলত ৩৪ টি ।

২. বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘ কার ’ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপ ' ফলা ' বিদ্যমান ।

৩. এ ভাষায় একই ব্যঞ্জনধ্বনির জন্য একাধিক লিপিরূপ রয়েছে । যেমন— দুটি ‘ জ ’ ( জ , য ) ; দুটি ন ( ণ , ন ) ; তিনটি শ ( শ , স , ষ ) , দুটি ত ( ত , ৎ ) ইত্যাদি ।

৪. বাংলা ভাষায় প্রচুর যুক্তব্যঞ্জন ও যুগ্মব্যঞ্জন রয়েছে । যেমন— যুক্তব্যঞ্জন : ক্স , স্ট , ষ্ঠ , প্ট । যুগ্মব্যঞ্জন : ক্স , স্ম , ব্ব ইত্যাদি ।

৫. বাংলা ভাষায় এমন কিছু বর্ণ রয়েছে , যেগুলাের উচ্চারণ অভিন্ন । যেমন— ন ও ণ , জ ও য ইত্যাদি ।

৬. এ ভাষায় সন্ধির মাধ্যমে প্রচুর ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে থাকে । যেমন প্রতি + আশা = প্রত্যাশা , নৌ + ইক = নাবিক ইত্যাদি ।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১. বাংলা ভাষায় প্রত্যয় , সমাস , উপসর্গ , শব্দদ্বিত্ব দ্বারা প্রচুর শব্দ গঠিত হয়েছে । যেমন : চল্ + অন্ত = চলন্ত ; নব রত্নের সমাহার = নবরত্ন ; উপ + হার = উপহার ।

২. এ ভাষার শব্দভাণ্ডার গঠনে বিভিন্ন ভাষা থেকে আগত ঋণ শব্দের ( আরবি , ফারসি , ইংরেজি , পর্তুগিজ ইত্যাদি ) আধিক্য রয়েছে ।

৩. বাংলা ভাষায় বহুবচন শব্দ গঠনে আগে বা পরে আলাদা শব্দ যুক্ত হয়ে থাকে । যেমন : সকল ছাত্রছাত্রী , শিক্ষকমণ্ডলী ইত্যাদি ।

৪. বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ভাষার মতাে নানারকম বিভক্তি নেই । আগে কিছু বিভক্তি দ্বারা পদ নির্মাণ হয় বলে বর্তমানে এ ভাষাকে বিভক্তি প্রধান ও বিশ্লেষণাত্মক ভাষার মধ্যবর্তী ভাষা হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় ।

বাক্যতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

১. বাংলা ভাষার বাক্য গঠন প্রক্রিয়া সাধারণত কর্তা + কর্ম + ক্রিয়া ( SOV) ধরনের । তবে এ নিয়মের বাইরেও প্রচুর বাক্য গঠিত হয় ।

২. এ ভাষার বাক্যে স্বাধীনভাবে শব্দের স্থান পরিবর্তনের সুযােগ নেই ।

৩. বাংলা বাক্যে ক্রিয়াপদের অব্যবহারের রীতি লক্ষণীয় ; অর্থাৎ ক্রিয়াপদ ছাড়াও বাক্য গঠিত হয় ।

৪. বাংলা বাক্যে বিশেষ্য বা বিশেষণকে ক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ।

৫. বাংলা ভাষার বাক্যরীতির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলাে সংযােগ প্রবণতা ।

বাংলা ভাষার গুরুত্ব

বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা । ফলে রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকাণ্ডে এবং জীবনের সর্বস্তরে প্রমিত বাংলা ভাষার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।

মধ্যযুগে বাংলা ভাষা দৈনন্দিন কাজকর্মের বাইরে মৌখিক লােকসাহিত্য ও লিখিত সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে কাব্যসাহিত্য রচনায় ব্যবহৃত হয়েছে । ফলে সে সময় এ দুটি ক্ষেত্রের মধ্যেই বাংলা ভাষার গুরুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল । আধুনিককালে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে , প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় , মুদ্রণ ও গণমাধ্যমে প্রমিত বাংলা ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে । ফলে এসব ক্ষেত্রের যেকোনাে পর্যায়ে অংশ নিতে কিংবা ভূমিকা পালন করতে হলে প্রমিত বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জন জরুরি ।

এককালে বাংলা লৈখিক গদ্যে সাধুভাষার আধিপত্য ছিল । কিছুকাল আগেও মুদ্রিত পত্র - পত্রিকায় সাধুভাষা প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল । এগুলাে বাংলা ভাষার ঐতিহ্যিক সম্পদ । বাংলা সাধুভাষায় রচিত এসব সম্পদের সঙ্গে পরিচিত হতে হলে সাধুরীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে ।

সাম্প্রতিককালে বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলা ভাষা তথ্য - প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে । বাংলা ভাষায় তৈরি হচ্ছে । অ্যাপস , সফটওয়্যার , হাজার হাজার ওয়েব । আধুনিক প্রতিযােগিতামূলক বিশ্বে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা এবং মর্যাদাপূর্ণ বিকাশে তথ্য - প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রয়ােগ দক্ষতা অর্জনও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে ।


আরো পড়ুন: