দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে ? দ্বিরুক্ত শব্দ কত প্রকার ও কি কি?

দ্বিরুক্ত শব্দ(Duplicate words)

চনচনে রােদ্দদুরে চকচক করে টাক ।
থমথমে গায়ে ডাকে মিশমিশে কাল কাক
ফিরফিরে হাওয়া খেতে ফিনফিনে জামা গায় ।
লিকলিকে ছড়ি হাতে গুটিগুটি বাবু যায় ।

সংজ্ঞা- “ দ্বিরুক্ত অর্থ “ দ্বিত্ব বা দু'বার উক্ত বা বলা বুঝায় । বাংলা ভাষায় কোন কোন শব্দ , পদ বা ধ্বনি দু'বার ব্যবহার করলে বিশেষ অর্থ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে । বাক্যে শব্দের এরূপ দ্বিত্ব বা দু'বার প্রয়ােগকে দ্বিরুক্ত শব্দ বলে । নিচের বাক্য দুটির অর্থ লক্ষ্য করঃ-

আমি জ্বর জ্বর বােধ করছি ।

এ অট্টালিকাটি এখন পড় পড় অবস্থা ।

উপরের প্রথম বাক্যে ‘ জ্বর জ্বর বলতে শরীরে ঠিক জ্বর হয়েছে না বুঝিয়ে জ্বরের ভাব বুঝাচ্ছে । তেমনি দ্বিতীয় বাক্যে ' পড় পড় ’ বলতে অট্টালিকাটি ঠিক ধসে পড়ে নি , তবে ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে - এরূপ অর্থ প্রকাশ করছে ।

দ্বিরুক্তির প্রয়ােজনীয়তা — দ্বিরুক্ত ভাষাকে শ্রুতিমধুর করে ও সঠিক অবস্থা বা ভাব প্রকাশে সহায়তা করে , যা সাধারণভাবে একবার প্রয়ােগে সম্ভবপর হয় না । সুতরাং নিখুঁত মনের ভাব প্রকাশে শব্দ দ্বৈতের অবদান অপরিসীম ।

দ্বিরুক্তির প্রকারভেদ - দ্বিরুক্তির সঠিক শ্রেণীবিভাগ করা কঠিন । তবে মােটামুটিভাবে দ্বিরুক্তিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথা- ( ১ ) শব্দাত্মক দ্বিরুক্তি , ( ২ ) পদাত্মক দ্বিরুক্তি ও ( ৩ ) ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি ।

দ্বিরুক্ত শব্দ কাকে বলে ? দ্বিরুক্ত শব্দ কত প্রকার ও কি কি?

১। শব্দাত্মক দ্বিরুক্তি- যে সব শব্দ তাদের আপন আকৃতিতে বিভক্ত হয় , তাদেরকে শব্দাত্মক দ্বিরুক্তি বলে । বিশেষ্য , বিশেষণ , সমাপিকা , অসমাপিকা ক্রিয়া ইত্যাদি সকল প্রকার শব্দের দ্বিরুক্তি হয় । যেমন-

বিশেষ্য - বাড়ী বাড়ী , বছর বছর , দিন দিন , বাটি বাটি , জ্বর জ্বর , রােজ রােজ ইত্যাদি ।

বিশেষণ - ঘন ঘন , বড় বড় , ভাল ভাল , কাল কাল , লাল লাল ইত্যাদি ।

সর্বনাম — যে যে , যা যা , কে কে , কেউ কেউ ইত্যাদি ।

সমাপিকা ক্রিয়া - গেল গেল , যায় যায় , এল এল ইত্যাদি ।

অসমাপিকা ক্রিয়া - দেখতে দেখতে , হেসে হেসে , কাঁদতে কাঁদতে , বলে বলে ইত্যাদি ।

২। পাত্মক দ্বিরুক্তিযে সকল বিভক্তিতে শব্দবিভক্তি যুক্ত হয়ে শব্দ গঠিত হবার পর , সে পদের আকৃতিতেই বিভক্ত হয় , তাদেরকে পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলে । যেমন-

বিশেষ্য পদ - চোর চোর , গোলায় গােলায় , গলায় গলায় , ভাইয়ে ভাইয়ে , চুলে চুলে ইত্যাদি ।

বিশেষণ পদ – ভালয় ভালয় , ধনীতে ধনীতে , দাতায় দাতায় , উঁচায় নীচায় , ছােটতে বড়তে ইত্যাদি।

সর্বনাম পদ - কে কে , কার কার , কাকে কাকে , কেউ কেউ ইত্যাদি ।

ক্রিয়া পদ - বলতে বলতে , ফিরে ফিরে , হাটি হাটি , আসি আসি ইত্যাদি ।

৩। ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তিযে সকল শব্দ কোন ধ্বনি বা আওয়াজের অনুকৃতিরূপে দ্বিরুক বা দু'বার প্রয়োগ হয় , তাদেরকে ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে । ধ্বন্যাতক দ্বিরুক্ত শব্দ কয়েকটি উপায়ে গঠিত হয় । যেমন-

( ক ) মানুষের ধ্বনির অনুকার - ভেউ ভেউ , হি হি , হা হা , ট্যাঁ ট্যাঁ ইত্যাদি ।

( খ ) জীবজন্তুর ধ্বনির অনুকার- ঘেউ ঘেউ ( কুকুরের ডাক ) , মিউ মিউ ( বিড়ালের ডাক ) , কা কা ( কাকের ডাক ) ইত্যাদি ।

( গ ) বস্তুর ধ্বনির অনুকার - ঝম ঝম ( বৃষ্টির শব্দ ) , হু হু ( বাতাসের শব্দ ) , মড় মড় ( গাছভাঙ্গার শব্দ ) ইত্যাদি ।

সেরূপ - ঝন ঝন , কন কন , খা খা , স র্স , কল কল , ছল ছল , ঢং ঢং ইত্যাদি ।

দ্বিরুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতি

নিম্ন বর্ণিত উপায়ে দ্বিরুক্তির ব্যবহার করা যায়ঃ-

শব্দ ভিত্তিক- ( ১ ) একই শব্দ দু’বার ব্যবহার করে , যেমন - ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরছে । বড় বড় দালান কোঠায় এ শহর পরিপূর্ণ । এখন ভাল ভাল ফল বাজারে পাওয়া যায় ।

( ২ ) একই শব্দের সমার্থক অপর আর একটা শব্দ যােগ করে , যেমন — অনেকদিন হতে ছেলেটার কোন খোঁজ - খবর নেই । অনাথ ছেলেটাকে সে লালন - পালন করছে । সে অনেক ধন - দৌলত পেয়েছে ।

( ৩ ) জোড়ার দ্বিতীয় শব্দটির আংশিক পরিবর্তন করে , যেমন - তোমাদের মধ্যে গােলমাল মিটমাট কর । তাকে বকাঝকা করাে না । রকমসকম দেখে আমরা সরে পড়লাম ।

( ৪ ) সমার্থক বা বিপরীত শব্দ যােগ করে , যেমন — আমার দেনা - পাওনা আগে বুঝে দাও । আইনের চোখে ধনী - গরীব সমান । ছেলেটা এ বাড়ীতে প্রায়ই আসা - যাওয়া করে ।

পদভিত্তিক– ( ১ ) অবিকল পদের দ্বিত্ব বা দু'বার প্রয়ােগ করে , যেমন- ঘরে ঘরে অশান্তি লেগে আছে । গ্রামে গ্রামে মহামারী দেখা দিয়েছে । দেশে দেশে এখন হাহাকার ।

( ২ ) দ্বিতীয় পদের আংশিক ধ্বনির পরিবর্তন ঘটিয়ে , যেমন - চোরটি হাতেনাতে ধরা পড়েছে । দুধেভাতে ছেলেটা এ যাবৎ মানুষ হয়েছে । লােকটি যথেষ্ট হেস্তনেস্ত হয়েছে ।

দ্বিরুক্ত শব্দের বিভিন্ন প্রয়ােগ

( ১ ) বিশেষ্যের দ্বিরুক্তি-

ক ) আধিক্য বুঝাতে- বস্তা বস্তা চাউল নষ্ট হয়েছে ।
খ ) ক্রমাগততী বুঝাতে - দিন দিন তুমি রােগা হচ্ছে ।
গ ) সামন্যতা বুঝাতে — আমি জ্বর জ্বর বােধ করছি ।
ঘ ) বেশী আগ্রহ বুঝাতে — ভাই ভাই বলে সে পাগল ।
ঙ ) ক্রিয়া বিশেষণ বুঝাতে — চোর চোর খেলা বেশ জমেছে ।
( ২ ) বিশেষণের দ্বিরুক্তি -
ক ) আধিক্য বুঝাতে - বাজারে ভাল ভাল আম - জাম পাওয়া যাচ্ছে।
খ ) তীব্রতা ও ধরন বুঝাতে — গরম গরম জিলাপী খেতে মজা ।
গ ) সামান্যতা বুঝাতে — তােমার উড়ু উড়ু , ভাব কেন ?
( ৩ ) ক্রিয়াবাচক শব্দের দ্বিরুক্তি -
ক ) স্বল্পকাল বুঝাতে - দেখতে দেখতে আকাশ মেঘে ঢেকে গেল ।
খ ) বিশেষ অবস্থা বুঝাতে — রােগী এখন যায় যায় অবস্থা ।
গ ) ক্রিয়া বিশেষণ গঠনে — সব কিছু দেখে দেখে পথ চলা ।
ঘ ) পৌনঃপুনিকতা বুঝাতে— ডেকে ডেকে হয়রান হলাম ।
( 8 ) অব্যয় শব্দের দ্বিরুক্তি-
ক ) ভাবের গভীরতা বুঝাতে - তার দুঃখে সবাই হায় হায় করতে লাগল ।
খ ) অনুভূতি বুঝাতে — ভয়ে গা ছম ছম করতে লাগল ।
গ ) পৌনঃপুনিকতা বুঝাতে — বার বার কামান গর্জে উঠল ।
ঘ ) বিশেষণ বুঝাতে — মিট মিট করে প্রদীপ জ্বলছে ।
(ঙ) ধ্বনির ব্যঞ্জনা বুুুুুঝাতে - বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান ।

যুগারীতিতে দ্বিরুক্তির গঠন

একই শব্দের সামান্য পরিবর্তন করে দ্বিরুক্ত শব্দ গঠনের পদ্ধতিকে যুগারীতি বলে । যুগরীতিতে শব্দ গঠনের কয়েকটি নিয়ম আছে । যেমন -

১ ) শব্দের আদিস্বরের পরিবর্তন দ্বারা , যথা – মিটমাট , চুপচাপ , জারিজুরি , ফিটফাট ইত্যাদি ।

২ ) শব্দের অন্ত্যস্বরের পরিবর্তন দ্বারা , যেমন — মারামারি , হাতাহাতি , জেদাজেদি ইত্যাদি ।

৩ ) দ্বিতীয় বার ব্যবহারের সময় ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন দ্বারা , যেমন- ছটফট , নিশপিশ , ভাতটাত ইত্যাদি ।

৪ ) সমার্থক বা একার্থক সহচর দ্বারা , যেমন — চালচলন , রীতিনীতি , তড়িঘড়ি , ভয়ডর ইত্যাদি ।

৫ ) ভিন্নার্থক শব্দ যােগ দ্বারা , যেমন – তালাচাবি , অলিগলি , পথঘাট , ডালভাত ইত্যাদি ।

৬ ) বিপরীত শব্দ যােগ দ্বারা , যেমন – ছােট - বড় , উচ্চ - নীচ , জন্ম - মৃত্যু , আসা - যাওয়া , আদান - প্রদান ইত্যাদি ।

পদাত্মক দ্বিরুক্তি

বিভক্তিযুক্ত পদের দু'বার ব্যবহারকে পদাত্মক দ্বিরুক্তি বলে । এগুলাে প্রধানতঃ দু'ভাগে গঠিত হয় । যথা-

১ ) এক পদের অবিকল দু'বার ব্যবহার দ্বারা , যেমন – ভয়ে ভয়ে আমরা অগ্রসর হতে লাগলাম ।

২ ) যুগারীতিতে গঠিত দ্বিরুক্ত পদের ব্যবহার দ্বারা , যেমন - চোরটি হাতেনাতে ধরা পড়ল । বাঘে - মহিষে লড়াই বেধেছে ।

বাগধারায় দ্বিরুক্ত শব্দ প্রয়ােগে বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে । যেমন-

ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখ । ( সতর্কতা )

লােকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান । ( আধিক্য )

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাগান দেখাশুনা করবে । ( অবসর )

লােকের মুখে মুখে এ দুর্নাম রটল । ( বিস্তার )

ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি

কোন কিছুর স্বাভাবিক বা কাল্পনিক অনুকৃতি বিশিষ্ট শব্দের রূপকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে । এরূপ ধ্বন্যাত্মক শব্দের দু'বার প্রয়ােগকে ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি বলে । ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুত্ব , আধিক্য ইত্যাদি বুঝায় ।

ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্তির গঠন

১ ) একই শব্দের অবিকল দ্বিত্ব প্রয়ােগ দ্বারা , যেমন — ঝনঝন , কনকন , পটপট ইত্যাদি ।

২ ) প্রথম শব্দের শেষে আ যােগ দ্বারা , যেমন — গপাগপ , টপাটপ , পটাপট ইত্যাদি ।

৩ ) দ্বিতীয় শব্দের শেষে ' ই ' যােগ দ্বারা , যেমন — ধরাধরি , ঝনঝনি , কনকনি , ঝমঝমি ইত্যাদি ।

৪ ) যুগরীতিতে গঠিত ধ্বন্যাত্মক শব্দ দ্বারা , যেমন — কিচির মিচির , টাপুর টুপুর , হাপুস হুপুস ইত্যাদি ।

৫ ) আনি ' প্রত্যয় যোগ দ্বারা , যেমন — ছটফটানি , বকবকানি ইত্যাদি ।

ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দ বিভিন্ন পদরূপে ব্যবহৃত হয় । যেমন-

১ ) বিশেষ্য - বৃষ্টির ঝমঝমানি আর ভাল লাগে না ।

২ ) বিশেষণ - নামিল বাদল যেন ছলছল বেদনায় ।

৩ ) ক্রিয়া - কলকলিয়ে উঠল সেথায় নারীর প্রতিবাদ ।

৪ ) ক্রিয়া বিশেষণ - চিকমিক করে বালি কোথা নাই কাদা ।


আরো পড়ুনঃ