আর্নেস্ট রাদারফোর্ড: নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, যিনি লর্ড রাদারফোর্ড নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন নিউজিল্যান্ডীয়-ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী। তাকে "নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক" হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি পরমাণুর গঠন সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন এবং তেজস্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সব আবিষ্কার করেছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াস

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড: নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা (১৮৭১ - ১৮৯৫)

আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের জন্ম ১৮৭১ সালের ৩০ আগস্ট, নিউজিল্যান্ডের নেলসনের কাছে ব্রাইটওয়াটার নামক একটি ছোট গ্রামে। তার বাবা জেমস রাদারফোর্ড ছিলেন একজন স্কটিশ কৃষক ও প্রকৌশলী এবং মা মার্থা থম্পসন ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। বারো ভাইবোনের মধ্যে আর্নেস্ট ছিলেন চতুর্থ।

গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে উঠলেও রাদারফোর্ডের পড়াশোনার প্রতি ছিল গভীর আগ্রহ। তার মা শিক্ষিকা হওয়ায় তিনি প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ যত্ন পান। তিনি নেলসন কলেজ থেকে বৃত্তি লাভ করেন এবং পরবর্তীতে ক্যান্টারবেরি কলেজ (বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যান্টারবেরি)-এ ভর্তি হন।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড: নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক

১৮৯৪ সালে তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে বি.এ. এবং এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ক্যান্টারবেরিতে থাকাকালীন তিনি লোহার চৌম্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ওপর গবেষণা শুরু করেন, যা সে সময়ের জন্য বেশ উন্নত একটি কাজ ছিল।

কেমব্রিজে আগমন ও প্রাথমিক গবেষণা (১৮৯৫ - ১৮৯৮)

১৮৯৫ সালে রাদারফোর্ড "এক্সজিবিশন ১৮৫১" নামক একটি সম্মানজনক বৃত্তি লাভ করেন, যা তাকে ইংল্যান্ডে গিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করার সুযোগ করে দেয়। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন।

এই ল্যাবরেটরির পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন (যিনি ইলেক্ট্রন আবিষ্কার করেন)। থমসনের তত্ত্বাবধানে রাদারফোর্ড এক্স-রে (X-rays) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে খুব দ্রুতই তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ফরাসি বিজ্ঞানী অঁরি বেকেরেল কর্তৃক সদ্য আবিষ্কৃত ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা।

রাদারফোর্ড আবিষ্কার করেন যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দুই ধরনের কণা দ্বারা গঠিত। তিনি এদের নামকরণ করেন আলফা (α) কণা (ধনাত্মক চার্জযুক্ত) এবং বিটা (β) কণা (ঋণাত্মক চার্জযুক্ত)।

ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার (১৮৯৮ - ১৯০৭)

১৮৯৮ সালে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে, রাদারফোর্ড কানাডার মন্ট্রিলে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ম্যাকগিলে কাটানো নয় বছর ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময়গুলোর একটি।

এখানে তিনি রসায়নবিদ ফ্রেডরিক সডির সাথে কাজ করে তেজস্ক্রিয়তার একটি নতুন তত্ত্ব প্রদান করেন। তারা প্রমাণ করেন যে, তেজস্ক্রিয়তা হলো এক ধরনের পারমাণবিক রূপান্তর (atomic transmutation) — অর্থাৎ, একটি মৌলের পরমাণু স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি মৌলের পরমাণুতে পরিণত হয়। এটি ছিল এক বৈপ্লবিক ধারণা, কারণ তৎকালীন রসায়নের মূল ভিত্তি ছিল যে, মৌলসমূহ অপরিবর্তনীয়।

তিনি "অর্ধায়ু" (Half-life)-এর ধারণা প্রবর্তন করেন, যা তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয়ের হার পরিমাপের একটি মৌলিক একক। তেজস্ক্রিয়তার ওপর এই অসামান্য গবেষণার জন্য, রাদারফোর্ডকে ১৯০৮ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। (মজার বিষয় হলো, তিনি নিজেকে পদার্থবিদ মনে করলেও পুরস্কার পান রসায়নে!)

ম্যানচেস্টার ও স্বর্ণপাত পরীক্ষা (১৯০৭ - ১৯১৯)

১৯০৭ সালে রাদারফোর্ড ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই তিনি তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষাটি সম্পন্ন করেন, যা "রাদারফোর্ডের স্বর্ণপাত পরীক্ষা" (Gold Foil Experiment) নামে পরিচিত।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড: নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক

এই পরীক্ষায় তার দুই সহকারী হ্যান্স গাইগার এবং আর্নেস্ট মার্সডেন একটি পাতলা সোনার পাতের ওপর দ্রুতগতির আলফা কণা নিক্ষেপ করেন। তৎকালীন প্রচলিত "প্লাম পুডিং মডেল" (থমসনের মডেল) অনুসারে, পরমাণু ছিল একটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত গোলক, যার মধ্যে ইলেকট্রনগুলো কিশমিশের মতো গেঁথে থাকে। এই মডেল সঠিক হলে, ভারী আলফা কণাগুলো সোনার পাত ভেদ করে সামান্য বেঁকে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফলাফল ছিল বিস্ময়কর:

  • বেশিরভাগ আলফা কণা সোজাসুজি চলে যায়।
  • কিছু কণা সামান্য কোণে বেঁকে যায়।
  • কিন্তু প্রায় প্রতি ৮,০০০ কণার মধ্যে একটি কণা ৯০ ডিগ্রীর চেয়েও বড় কোণে বেঁকে যায়, বা সরাসরি ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে!

রাদারফোর্ড এই ফলাফলকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে: "এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ঘটনা... ঠিক যেমন আপনি যদি একটি টিস্যু পেপারের ওপর ১৫ ইঞ্চি কামানের গোলা ছুঁড়তেন এবং সেটি উল্টো আপনার দিকেই ফিরে আসত।"

এই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে ১৯১১ সালে রাদারফোর্ড পরমাণুর নতুন মডেল প্রস্তাব করেন, যা "রাদারফোর্ডের পারমাণবিক মডেল" বা "সৌরজাগতিক মডেল" নামে পরিচিত:

পরমাণুর কেন্দ্রে একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ঘন, এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত বস্তু রয়েছে, যাকে তিনি "নিউক্লিয়াস" (Nucleus) নাম দেন। পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর এই নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং হালকা ইলেকট্রনগুলো গ্রহের মতো এই নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে।

এই আবিষ্কারই নিউক্লীয় যুগের সূচনা করে।

শেষ জীবন: ক্যাভেন্ডিশ ও প্রোটন আবিষ্কার (১৯১৯ - ১৯৩৭)

১৯১৯ সালে রাদারফোর্ড তার গুরু জে. জে. থমসনের স্থলাভিষিক্ত হয়ে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির পরিচালক হন। তার নেতৃত্বেই এই ল্যাবরেটরি বিশ্বসেরা গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ম্যানচেস্টারে থাকতেই তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেন, যা কেমব্রিজে এসে চূড়ান্ত রূপ পায়। ১৯১৭ সালে তিনি নাইট্রোজেন গ্যাসের মধ্য দিয়ে আলফা কণা চালনা করে দেখান যে, এর ফলে হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস নির্গত হয়। এটি ছিল ইতিহাসে প্রথম কৃত্রিম মৌলান্তর (artificial transmutation) — অর্থাৎ, মানুষ প্রথমবারের মতো এক মৌলকে অন্য মৌলে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলো।

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড: নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের জনক

তিনি এই নির্গত হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের নাম দেন "প্রোটন" (Proton) এবং প্রস্তাব করেন যে এটিই সকল পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের মৌলিক উপাদান।

রাদারফোর্ডের তত্ত্বাবধানে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে জেমস চ্যাডউইক নিউট্রন আবিষ্কার করেন এবং ককক্রফট ও ওয়ালটন প্রথম কৃত্রিম উপায়ে পারমাণবিক বিভাজন (splitting the atom) ঘটান।

সম্মাননা ও মৃত্যু

বিজ্ঞান ও মানবতার প্রতি অসামান্য অবদানের জন্য রাদারফোর্ড অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯১৪ সালে 'নাইট' উপাধি লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তাকে "ব্যারন রাদারফোর্ড অফ নেলসন" উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হয়।

১৯৩৭ সালের ১৯ অক্টোবর, ৬৭ বছর বয়সে, লর্ড রাদারফোর্ড হঠাৎ করেই অন্ত্রবৃদ্ধিজনিত জটিলতায় (strangulated hernia) মারা যান। তার মতো একজন মহান বিজ্ঞানীর জন্য এটি ছিল একটি অপ্রত্যাশিত ও অকাল প্রয়াণ। তাকে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে স্যার আইজ্যাক নিউটন এবং লর্ড কেলভিনের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয়, যা একজন বিজ্ঞানীর জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান।

শেষ কথা....

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড কেবল একজন বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মহান শিক্ষক ও নেতা। তার হাত ধরে এক ঝাঁক ভবিষ্যৎ নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী (যেমন: জেমস চ্যাডউইক, নিলস বোর, অটো হান) তৈরি হয়েছিলেন। তার আবিষ্কার পরমাণুর ক্ষুদ্র জগত থেকে শুরু করে পারমাণবিক শক্তির অপার সম্ভাবনা—উভয়ের দরজাই খুলে দিয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনি চিরকাল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবেন।