বৈষম্যমূলক সমাজ গঠনে রাসুল (সা.) এর ভূমিকা রচনা

বৈষম্যমূলক সমাজ গঠনে রাসুল (সা.) এর ভূমিকা

ভূমিকা:

মানবজাতির ইতিহাসে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সেই নেতাদের মধ্যে অন্যতম। যিনি তাঁর জীবন ও কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শ প্রদর্শন করেন। তাঁর প্রবর্তিত ইসলামের নীতিগুলি মানবতার প্রতি ভালোবাসা, সাম্য এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে আজও বিদ্যমান।

বৈষম্যের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ:

বৈষম্য বলতে বোঝানো হয় একদল মানুষকে অন্যদের তুলনায় কম মর্যাদা, সুযোগ, বা সুবিধা দেওয়া। এটি বিভিন্ন রূপে সমাজে বিদ্যমান থাকে, যেমন:
ধর্মীয় বৈষম্য: ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ বা নিপীড়ন।
জাতিগত বৈষম্য: বিভিন্ন জাতি বা বর্ণের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।
লিঙ্গ বৈষম্য: নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতা বা বৈষম্যপূর্ণ আচরণ।
সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদার বৈষম্য: ধনী-গরিবের মধ্যে অসমতা এবং শ্রেণিভেদ।
মহানবী (সা.)-এর আগমনের পূর্বে আরব সমাজে এই সব ধরণের বৈষম্য ছিল প্রকট। নারীদের প্রতি অবমাননা, দাসপ্রথা, কুরাইশ গোত্রের আধিপত্য, এবং বর্ণগত বৈষম্য তখনকার সমাজে গভীরভাবে শেকড় গেঁড়ে বসেছিল।

রাসুল (সা.)-এর আগমনের প্রেক্ষাপট:

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের পূর্বে আরব সমাজে এমন এক পরিবেশ বিরাজমান ছিল, যেখানে মানবতার কোনো স্থান ছিল না। অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার পরিবর্তে সমাজ বিভক্ত ছিল শ্রেণি ও গোত্রভিত্তিক বৈষম্যের ওপর। এই পরিস্থিতিতে রাসুল (সা.) একজন নবী হিসেবে আবির্ভূত হন এবং আল্লাহর প্রেরিত বাণীর মাধ্যমে তিনি সমতার নীতি প্রচার করতে শুরু করেন।

সাম্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান:

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো "তাওহীদ" বা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, যা সরাসরি মানুষের মধ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রতিষ্ঠা করে। রাসুল (সা.) বলেন: "তোমাদের সকলেই আদমের সন্তান, আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট।” — (তিরমিজি)

এই বক্তব্যের মাধ্যমে রাসুল (সা.) মানবজাতির সকলকে একই উৎস থেকে সৃষ্ট বলে ঘোষণা করেন, যেখানে বর্ণ, ধর্ম বা জাতিগত পার্থক্যের কোনো স্থান নেই। আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহকে সর্বাধিক ভয় করেন এবং ধর্মীয়ভাবে তার প্রতি অনুগত থাকেন।

দাসপ্রথা বিলোপে রাসুল (সা.)-এর ভূমিকা:

মহানবী (সা.) দাসদের প্রতি অত্যন্ত সম্মানজনক আচরণ করতেন এবং তাদের মুক্তির জন্য উৎসাহিত করতেন। সে সময় আরবে দাসপ্রথা ছিল খুবই প্রচলিত। রাসুল (সা.) তাদের সাথে যে দয়া ও সহানুভূতির আচরণ করেছিলেন, তা দাসদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। তিনি বলেছিলেন: “তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের সাথে এমন আচরণ করো যেন তারা তোমাদের ভাই।”— (বুখারী)

তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, যারা দাসদের মুক্তি দিতে পারে, তাদের উচিত দাসদের মুক্ত করে দেওয়া। ইসলামে এমন অনেক আইন প্রবর্তন করা হয়েছে যা দাসপ্রথাকে নির্মূল করার দিকে ধাবিত হয়। রাসুল (সা.) নিজেও একাধিক দাসকে মুক্ত করেছিলেন এবং তাদেরকে সামাজিকভাবে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা:

নারীদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ ও তাঁর শিক্ষাগুলো নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে। পূর্বের সমাজে নারীদের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না; নারীরা কেবল পরিবার ও সমাজের এক প্রান্তিক অবস্থানে ছিল। কিন্তু রাসুল (সা.) বলেন: “নারী ও পুরুষ পরস্পরের সহযোগী।” — (তিরমিজি)

নারীদের অধিকার নিয়ে তিনি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। নারীর সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদে তার সম্মতি, এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তির মতো বিষয়গুলিতে রাসুল (সা.) অত্যন্ত শক্তিশালী নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.) এবং কন্যা ফাতিমা (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আচরণ ছিল আদর্শিক, যা নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য দূরীকরণ:

রাসুল (সা.) বারবার বলেছেন যে, আল্লাহর কাছে ধনী-গরিব, জাতি বা বর্ণের কোনো পার্থক্য নেই। তিনি সকল মানুষের প্রতি সমান আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি ঘোষণা করেন: “কুরাইশ গোত্রের লোকেরা, তোমাদের মধ্যে কেউ ধনী বা গরিব হতে পারে, কিন্তু তোমাদের আল্লাহর সামনে সমান মর্যাদা।

মদীনায় হিজরতের পর মুজাহির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেন, যা এক অনন্য উদাহরণ। দুই ভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্রিত করে রাসুল (সা.) সাম্যের এক মহান উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন।

শেষ বিদায় হজের ভাষণ:

রাসুল (সা.)-এর জীবন ও সমাজবিন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো তাঁর শেষ বিদায় হজের ভাষণ। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন:

হে মানবজাতি! তোমাদের প্রভু এক, তোমরা সবাই আদমের সন্তান। আরবের উপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, অনারবের উপরও আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদা চামড়ার উপর কালো চামড়ার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কালো চামড়ার উপরও সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।

এই ভাষণ ছিল মানবজাতির জন্য এক অভূতপূর্ব নির্দেশনা, যা বৈষম্যহীন সমাজের জন্য এক অবিস্মরণীয় আদর্শ। এখানে রাসুল (সা.) প্রথমবারের মতো একটি সামগ্রিক বিশ্বভ্রাতৃত্বের নীতির কথা তুলে ধরেন, যা ধর্ম, বর্ণ, জাতি, এবং লিঙ্গের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবসমাজকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসে।

রাসুল (সা.)-এর বৈষম্যহীন সমাজের মূলনীতি:

রাসুলুল্লাহ (সা.) যে নীতিগুলি প্রচার করেছিলেন, তা একটি সাম্য ও ন্যায়ের সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল:

সমানাধিকার: সকলের জন্য সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

ভ্রাতৃত্ব: মুসলিমদের মাঝে একটি ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা, যেখানে কোনো বিভাজন নেই।

সহমর্মিতা ও সহানুভূতি: দুঃস্থ ও নিপীড়িতদের সাহায্য এবং সমর্থন প্রদান করা।

তাকওয়া: ব্যক্তিগত পুণ্য এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করা, জাতি বা বর্ণ নয়।

উপসংহার:

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং মানুষের মধ্যে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর আদর্শ ও শিক্ষা আজও বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করে। মানবতার জন্য তাঁর অবদান একটি চিরন্তন শিক্ষারূপে বিদ্যমান, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক করে তুলতে সহায়ক। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুল (সা.)-এর জীবন ও নির্দেশনা অনুসরণ করা, মানবতার প্রতি এক গভীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।