বঙ্গবন্ধু জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস রচনা

বঙ্গবন্ধু জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস

বঙ্গবন্ধু জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস রচনা

ভূমিকা:


"আজকের শিশু / পৃথিবীর আলোয় এসেছে
আমরা তার তবে একটি সাজানো বাগান চাই'।

প্রবীণ শিল্পীদের দরদ ভরা কন্ঠে গান হয় একটা বিষয়ের আরতি জানাই- শিশুর অধিকার কি? শিশুর অধিকার যেন আজ সবার মাঝে সোচ্চার কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আজকে যে শিশুটি জন্ম নিল একদিন সেই তো বড় হয়ে নামকরা সাহিত্যিক, স্বনামধন্য ডাক্তার, খ্যাতিমান শিল্পী বা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হবে। কিন্তু কি দেখছি আমরা? তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের দিকে তাকালেই তাদের নানা করুণ চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তারা ক্ষুদায় পায় না অন্ন, চিকিৎসার জন্য ওষুধ। শুধু তাই নয়- বাসস্থান ও শিক্ষার মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও তারা বঞ্চিত। এসব শিশুর কতজন কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামার, শ্রমিকের কাজ করে। কতজন টোকাই কতজন ক্ষুধা ও অপুষ্টি আর রোগের কবলে পড়ে অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, কে রাখে তাদের খবর?

বিশ্ব শিশু দিবস কি?:

জাতিসংঘ হাজার ১৯৫৪ সালে এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার "বিশ্ব শিশু দিবস" পালন করা হয়। বাংলাদেশের ১৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনেই "শিশু দিবস" পালন করা হয়। এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো- শিশু-কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে ও তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ দিতে হবে।

শিশু দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় ও বেদনাদায়ক স্মৃতি এ দিবসটি জন্ম দেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপের শত শত ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশু মারা যায়। অনেক বড় শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হাজার হাজার শিশু অসহায় ও পিতৃ- মাতৃহীন হয়ে পড়ে। পঙ্গু ও বিকলঙ্গ হয়ে অনেকে। জাতিসংঘ কল্যাণ তহবিল (UNICEF) এই অসহায় শিশুদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসে এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এদিন সামগ্রিক আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিশুদের সমস্যা গুলি বিশ্ব ফোরামে তুলে ধরে এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে। তাই ১৯৫৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

শিশু দিবসের তাৎপর্য:

বিশ্ব শিশু দিবসের তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক। তাই জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাবিশ্বে অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস। । এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুদের কল্যাণ সাধন এবং তাদের নানাবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করে তাদের মৌলিক অধিকার আদায় করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখনো "বিশ্ব শিশু দিবস" সম্পর্কে সচেতন নয়। এর জন্য এর কর্মসূচি এমনভাবে করতে হবে যেন জনগন এর তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। কেবলমাত্র কাগজ দিয়ে কলমে শিশুদের অধিকারের কথা লিখে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাস্তবে রূপ দিতে হবে। এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবার। তৃতীয় বিশ্বের সন্তানদের দিকে তাকালে একটা বিষয় ধরা পড়ে- বিশ্ব শিশু দিবস, শিশু সনদ ইত্যাদি যেন আমাদের সন্তানের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ কতটুকু তা ভাবার বিষয়।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ:

আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। একটি নবজাতক শিশুর মধ্যে আজ যে প্রাণের সঞ্চার ঘটলো তা একদিন ফুলে-ফলে প্রস্ফুটিত হবে। বড় হয়ে একদিন সে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সফল হবে। Wordsworth এর ভাষায়- "Child is the father of a nation", বস্তুত শিশুর মধ্যে নিহিত রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। কারণ শিশু একদিন বড় হয়ে দেশ সমাজের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারা হবে দেশের আদর্শ নাগরিক। এজন্য চাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন, বিকাশ সাধনে সুষ্ঠু পরিবেশ। শিশুদেরকে আদর-সোহাগ, যত্ন, ও সুশিক্ষা দিয়ে বড় করে তোলার জন্য প্রায় অনুকূল পরিবেশ উপযুক্ত শিক্ষা। উপযুক্ত অভিভাবক পেলে একটি শিশু আদর্শ মানুষরূপে বড় হয়ে উঠতে পারে। শিশু ফুলের মত পবিত্র ও সরল। সে যে পরিবেশে থাকে তার পারিপার্শ্বিক আচার-আচরণ অনুকরণ করে এবং তাতে অভ্যন্ত হয়ে পড়ে। একটি নির্মল ফুলের মত পবিত্র শিশু খারাপ পরিবেশে ও উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ ও অসৎ সঙ্গ বিবেচনাহীন অভিভাবকের অধীনে বড় হয়েও অমানুষ, বিবেকহীন ও লম্পট চরিত্র হতে পারে।

সম্ভাবনাময় আগামী দিনের এক সুনাগরিক এভাবেই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে সুশিক্ষায় শিক্ষিত বিবেকবান অভিভাবক একটি শিশুর অন্তর্ভুক্ত ভবিষ্যতের পিতা কে জাগিয়ে তুলতে পারেন। আর উন্নতচরিত্র মহান মানুষের সমবায় একটি মহৎ জাতি গড়ে ওঠে। যেহেতু শিশুর মধ্যে জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিজ লুকায়িত থাকে, তাই শিশুর সযত্ন প্রতিপালন, সুশিক্ষা ও চরিত্র গঠনে প্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে হবে এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।

শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য:

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৫ ভাগ শিশু। এটা পরম সত্য যে শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ এবং আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তারা একজন সুনাগরিক হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। তাই তারা অবহেলিত থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুখ থুবরে পড়বে। এহেন ভয়াবহ অবস্থার কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশেই শিশু সমাজকে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করছে- কি করে এদেরকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়? কিভাবে এদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সুন্দর মানব সমাজ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে শিশুকে গড়তে হবে। কারণ, শিশুর প্রতি অযত্ন অবহেলা কোন বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়।

বিশ্বে শিশুদের অবস্থান:

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত শিশু অধিকার গুলো সব দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতি দানকারী বহুদেশে এই অধিকারগুলো নানা কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বের একটি অংশের শিশুরা যেসব অধিকার ভোগ করছে অপর অংশের শিশুরা তা থেকে বঞ্চিত থাকছে। যেসব অধিকার ভোগের কোনো সুযোগই তাদের নেই। তারা পাচ্ছে না ক্ষুধার অন্ন পরনের কাপড় স্বাস্থ্য শিক্ষার সুবিধা। সমগ্র বিশ্বে অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বর্তমানে ১০০ কোটিরও বেশি। এমনকি অনেক মানব সন্তান আছে যারা বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছে না। বিশেষ করে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে এমনই অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত শিশুর সংখ্যা সর্বাধিক। আর সারা বিশ্বে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিবছর প্রায় ও লাখ শিশু অকালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

বাংলাদেশের শিশুদের বর্তমান অবস্থা:

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ধারা গুলো সব দেশ মেনে নিল বিশ্বের উন্নয়নশীল গরিব দেশগুলোর অর্থনৈতিক কারণে ধারাগুলো পুরোপুরি কার্যকর করতে পারছে না। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি শিশু-কিশোর রয়েছে। এদের জন্য খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশের নয় ভারত নেপাল মালয়েশিয়া শ্রীলংকা ইত্যাদি কোন দেশে শিশু অধিকার সনদ পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। এর মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র অর্থনৈতিক সংকট ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তবে চরম হতাশার মধ্যেও আশার কথা এই যে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কারখানায়ও রাস্তাঘাটে কর্মরত শিশুশ্রমিকের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া শিশু একাডেমী গড়ে তোলা হয়েছে। কচি কাঁচার আসর, শাপলা-শালুক, ফুলকুড়ি, খেলাঘর ইত্যাদি অনেক শিশু সংগঠন তৈরি করা হয়েছে। শিশু, নবারুন, সবুজ পাতা- এসব শিশু পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে। তাছাড়া জাতীয় প্রচার মাধ্যমে বিভিন্ন আঙ্গিকে অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয় যেমনঃ অংকুর, নতুন কুঁড়ি, ইত্যাদি।

উপসংহার:

মহাসমারোহে প্রতিবছর "বিশ্ব শিশু দিবস" পালিত হয়। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ কতটুকু? এর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আরেকটি সুষমামণ্ডিত নির্মল পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য। বিশ্ব শিশু দিবসে আমরা যেন বলতে পারি-

"প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে, শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার