মেসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম মেসওয়াক। নবিজি বলেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম অহি নিয়ে এসেছেন আর মেসওয়াকের কথা বলেননি- এমনটি কখনো হয়নি। তাই অবস্থা এমন মনে হতো যেন, মেসওয়াক করতে থাকার কারণে আমার মুখের অগ্রভাগ ছিলে যায়। (বুখারি, মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)

মেসওয়াকের গুরুত্ব ও ফজিলত

মানুষের প্রতিটি কাজে সুন্নাতে রাসূলের নির্দেশনা রয়েছে। নবীজি মেসওয়াকের নিয়ম, পদ্ধতি, ফজিলত ও মর্যাদা উল্লেখ করেছেন। মেসওয়াকের দুনিয়া ও আখেরাতে অসংখ্য বরকত ও উপকারিতা রয়েছে। মেসওয়াক কি? এর গুরুত্ব থেকে মেসওয়াকের উপকারিতা বেরিয়ে আসে।

মিসওয়াক করার উপকারীতা

১. মিসওয়াক করলে মুখের পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হয়।
২. খোদার সন্তুটি বুদ্ধি পায়। 
৩. রোগ জীবানু দূরীভূত হয়।
৪. অপর ভাই মুখের দুর্গন্ধ দ্বারা কষ্ট পায় না।
৫. মেধা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৬. মিসওয়াক করে নামায পড়রে ৭০ গুণ বেশী সওয়াব পাওয়া যায়।
৭. মৃত্যুকালে কালেমা নছিব হয়।
৮. দাঁত মজবুত হয়।
৯. দাঁতের মাড়ি শক্ত থাকে।
১০. দাঁত সুন্দর ও ঝকঝকে হয়
১১. চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়
১২. শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
১৩. মনে ফুর্তি থাকে।
১৪. ফেরেশতারা খুশি হয় ও দোয়া করে।
১৫. শয়তান বিতাড়িত হয়।
 আল্লামা শামী লিখেছেন, মিসওয়াকের ৭০ এর অধিক উপকারীতা রয়েছে তন্মধ্যে নূন্যতম একটি হলো মুখের কষ্টদায়ক দুর্গন্ধ দূরীভূত হয়। আর সর্বোচ্চ হলো মৃত্যুর সময় কালেমা নছীব হয়।

মিসওয়াকের শরয়ী মর্যাদা

শরীয়তে মিসওয়াক করা ওয়াজিব নাকি সুন্নত এ ব্যাপারে দু'ধরণের মতামত পাওয়া যায়।

১. জুমহুরের মতে মিসওয়াক করা সুন্নত; ওয়াজিব নয়। আল্লামা নববী (র) মিসওয়াক সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

২. ইমাম ইসহাক ও দাউদে জাহেরী থেকে এ ব্যাপারে দু'ধরণের বর্ণনা রয়েছে। ক. মিসওয়াক করা সুন্নত, খ. মিসওয়াক করা ওয়াজিব।

উযূ ও নামায ব্যতীত মিসওয়াকের মুস্তাহাব অবস্থাসমূহ

উযূ ও নামায ব্যতীত নিম্নবর্ণিত অবস্থায় মিসওয়াক করা মুস্তাহাব- 
১. দাঁত হলদে ও ময়লাযুক্ত হলে।
২. মুখ দুর্গগন্ধযুক্ত হলে।
৩. নিদ্রা থেকে উঠার পর।‬
৪. সফর থেকে আসার পর।
৫. কুরআন তিলাওয়াতের প্রাক্কালে।
৬. দীর্ঘ সময় চুপ থাকলে।
৭. দীর্ঘ সময় কথা বললে।
৮. খাওয়ার পর।
৯. দুর্গন্ধযুক্ত খাদ্য ভক্ষণের পর।

‎মিসওয়াক করা কি উযুর সুন্নত, না নামাযের সুন্নত

মিসওয়াক করা অযুর সুন্নত না নামাযের সুন্নত এ-বিষয়ে ইমামদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। নিম্নে তা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

১. ইমাম শাফেয়ী (র) এবং আহলে জাহেরদের নিকট এটা নামাযের সুন্নত উযূর সুন্নত নয়।

২. হানাফীগণ বলেন এটা উযূর সুন্নত নামাযের সুন্নত নয়।

ব্রাশ ও কাপড়ের টুকরার দ্বারা মিসওয়াকের বিধান

ব্রাশ, কাপড়ের টুকরা, মাজন বা অন্য কোন আধুনিক উপকরণ দ্বারা মিসওয়াক করলে সুন্নত আদায় হবে কিনা এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের সুচিন্তিত মতামত নিম্নে পেশ করা হলো।

একদল কট্টরপন্থী আলিমের মতে ব্রাশ বা এ জাতীয় কোন মাজনী দ্বারা মিসওয়াক করলে সুন্নত আদায় হবে না। গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করলে সুন্নত আদায় হবে।

ব্রাশ দ্বারা দাঁত মাজলে সুন্নত আদায় হবে কি না এ সম্পর্কে তাত্ত্বিক কথা হলো এখানে দুটি জিনিস আলাদা আলাদা রয়েছে- ১. মিসওয়াকের সুন্নত ২. মিসওয়াক সুন্নত হওয়ার রহস্য তথা দাঁত পরিষ্কার হওয়া।

ব্রাশের দ্বারা দাঁত পরিষ্কার হওয়ার সুন্নত আদায় হয়। কিন্তু মিসওয়াক ব্যবহার করার সুন্নত আদায় হয় না। কিন্তু যদি বিষয়টি এমন হয় যে, মিসওয়াক পাওয়া যাচ্ছে না তাহলে কাপড়, মাজন বা আঙ্গুলের দ্বারা যেমন মিসওয়াকের সুন্নত আদায় হয় ঠিক তদ্রুপ ব্রাশ দ্বারাও সুন্নত আদায় হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা।‬‎

রোজাদারের জন্যে বিকেলে মিসওয়াক করা জায়েয আছে কি?

রোযার দিন বিকেলে রোযাদারের জন্যে মিসওয়াক করা জায়েয কি না এ ব্যাপারে, ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।

১. ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও আবু ইউসুফ (র) এর অভিমত: ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও আবু ইউসুফ এর মতে রোযাদারের জন্যে বিকেলে মিসওয়াক করা মাকরূহ।

২. ইমাম আবু হানীফা ও মালেক(র) এর অভিমত: ইমাম আবু হানীফা ও মালেক (র) এর মতে রোযাদারের জন্যে বিকেলে মিসওয়াক করা জায়েয। এতে কোন অসুবিধা নেই।

ইমাম শাফেয়ী (র) এর দলীল : তাঁদের দলীল হলো রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট প্রিয়। আর দ্বিপ্রহরের পর পাকস্থলী খালী থাকে। সুতরাং তখন মিসওয়াক করলে দুর্গন্ধ চলে যায়। কাজেই এ সময় মিসওয়াক করা মাকরূহ।

হানাফীদের দলীল: ইমাম শাফেয়ী, আহমদ ও আবু ইউসুফ (র) এর দলীলের উত্তরে বলা যায়, রোযাদারের মুখের ময়লা থেকে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয় তা আল্লাহর নিকট প্রিয় নয়। বরং পাকস্থলী থেকে যে গন্ধ বের হয় তা প্রিয়।

মিসওয়াক সম্পর্কিত হাদীস ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি

অনেক বিজ্ঞানীগণ গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেন। জনৈক বিজ্ঞানী একটি নিমের ডাল পরীক্ষা করে দেখেন নিমের ডালের মধ্যে এমন পদার্থ রয়েছে যা মুখ ও দাঁতের জীবাণু নষ্ট করে এবং দাঁতের মাড়িকে শক্ত করে, মিসওয়াক ব্যবহার করলে চোখের জ্যোতি নষ্ট হয় না, এর দ্বারা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং চিন্তার মধ্যে স্বচ্ছতা আসে। অথচ এ বিষয়গুলো আমাদের নবী (স) ১৪০০ বছর পূর্বে বলে গেছেন যা এখন তারা বুঝতে পারছেন।

১. নামাযের পূর্বে মিসওয়াক করতে বলার হিকমত হলো, মিসওয়াক না করলে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে খাদ্যকণা আটকে থাকে যার দ্বারা নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয় এবং মুখের দুর্গন্ধ দ্বারা অন্য নামাযী কষ্ট পায়।

২. সুইজারল্যান্ডের এক ডাক্তারের মাড়িতে কঠিন রোগের সৃষ্টি হয়, যার চিকিৎসা তদানিন্তন ডাক্তারের নিকট ছিল দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু তিনি মিসওয়াক করতে শুরু করলে সে রোগ থেকে মুক্তি পান।

৩. হেকিম এস, এম, ইকবাল "জাহান" নামক পত্রিকায় লিখেন যে, এক ব্যক্তির হৃৎপিণ্ডের ঝিল্লিতে অনেক পুঁজ জমা হয়। অনেকবার চিকিৎসা ও অপারেশনের পরেও কোন ফল হয় না, পরে ডাক্তার তাকে পীলু বৃক্ষের মিসওয়াক ব্যবহার করতে বলেন এতে সে আরোগ্য পায় কারণ রোগটি ছিল তার দাঁতে।

৪. এক দন্ত চিকিৎসক বলেন ১০ হাজার দিরহাম খরচ করেও এক ব্যক্তি দাঁতের রোগ থেকে মুক্তি না পেয়ে আমার কাছে আসলে তাকে পীলু বৃক্ষের মিসওয়াক দ্বারা মিসওয়াক করতে বলি তার দ্বারা সে আরোগ্য পায়।

৬. জনৈক চিকিৎসক বলেন, এক টাকার পীলু বৃক্ষের মিসওয়াক হাজার টাকার ঔষধের চেয়ে অধিক ফলপ্রসু।

৭. ঘাড় ব্যথা, গলায় ব্যাথা ও জ্বালা-পোড়া, গলার স্বর হ্রাস পাওয়া, মস্তিষ্ক ও স্মরণ শক্তি হ্রাস পাওয়া, মাথা ঘুরানো ইত্যাদি রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় "থাইরাইড গ্লেড" এর কারণে। আর এর প্রতিষেধক হলো মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজা ও মিসওয়াক পানিতে ফুটিয়ে তাদ্বারা কুলি করা। জেনারেল ফিজিশিয়ান বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভিমত।

৮. কাঁচা মিসওয়াক দ্বারা দাঁত মাজলে গালের ঘা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 

৯ . মিসওয়াক দাঁতের হরিদ্রতা দূর করে।

১০. মিসওয়াক মুখের ভিতরকার জীবাণু ধ্বংস করে দেয়।

১১. মিসওয়াকের মধ্যে ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থ থাকে, যা দাঁতের প্রধান খাদ্য থাকে তাই মিসওয়াক পাইওরিয়ার ন্যায় মারাত্মক রোগ ব্যাধির মহৌষধ।

১২. অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময় পুঁজযুক্ত দাঁত, মস্তিষ্ক রোগের প্রধান কারণ। আর মিসওয়াকের দ্বারাই এর থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়।

১৩. যাদের কানে ফোলা, পুঁজ, রক্তিমতা ব্যাথা আছে পরীক্ষা করে দেখা গেছে মিসওয়াকই তার আরোগ্য দিতে পারে।

১৪. চক্ষুরোগ, দৃষ্টিশক্তি দুর্বল ও অন্ধত্বের মহা ঔষধ হলো মিসওয়াক।

১৫. বর্তমান বিশ্বে পাকস্থলীর রোগ এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এর মহৌষধ হলো মিসওয়াক।

১৬. স্থায়ী সর্দি কাশির রুগীর শ্লেষ্মা যদি জমাট বেঁধে থাকে, সেক্ষেত্রে মিসওয়াক ব্যবহার করলে শ্লেষ্মা ভিতর থেকে বের হয়ে মস্তিষ্ক হালকা হয়ে যায়। (ডাঃ মুহাম্মদ তারেক মাহমুদ এর গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে এখানে কিছু কথা উল্লেখ করা হলো)

রাতে মিসওয়াক ও আধুনিক বিজ্ঞান

মহামূল্যবান হীরার টুকরোকে ফেলে দিয়ে সামান্য এক টুকরো কাঁচ খণ্ড গ্রহণ করা যেমনি ভাবে বুদ্ধিহীনতা ও বোকামীর কাজ ঠিক তেমনি মিসওয়াকের আমলটিকে পরিত্যাগ করাও অজ্ঞতার পরিচায়ক। মিসওয়াক সম্পর্কে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তার পাণ্ডিত্যসুলভ উক্তি এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, যে দিন থেকে আমরা মিসওয়াক ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছি সেদিন থেকেই "ডেন্টাল সার্জন" এর সূত্রপাত হয়েছে।

ওয়াশিংটন এর একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার বললেন,  শয়নকালে মিসওয়াক করার কথা। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানুষ যা ভক্ষণ করে তার ময়লা কুলির দ্বারা পরিপূর্ণ পরিষ্কার হয় না, তিনি আরো বলেন যে, সাধারণত মানুষের দাঁত নষ্ট হয় শয়নকালে। এর কারণ কি জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, দিনের বেলায় মানুষ কখনো কথা বলছে, কখনো আহার করছে আবার কখনো পান করছে। তাই দিনের বেলায় মুখের গতিশীলতার কারণে রক্তরস বা রক্তলসিকা তার কাজ করার সুযোগ পায় না, কিন্তু রাতের বেলা যখন মুখ বন্ধ হয়ে যায় তখন তার সুযোগ এসে যায় কাজ করার। এ কারণেই দাঁত রাতের বেলায় অধিক খারাপ হয়। তিনি আরো বললেন, সকালে টুথ পেষ্ট করেন আর না করেন শোয়ার সময় অবশ্যই মিসওয়াক করে ঘুমাবেন। বিজ্ঞ ডাক্তার সাহেবের মুখে একথা শুনে আমি শুকরিয়া জ্ঞাপনস্বরূপ আলহামদুলিল্লাহ পড়ে নিলাম, কেননা এটাইতো আমাদের নবী করীম (স) এর সুন্নত।