প্রবন্ধ রচনা: বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গণে সংকট ও সমাধান

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গণে সংকট ও সমাধান

ভূমিকা :

শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির সোপান। 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড' একটি আন্তবাক্য বলে আমাদের সবার জানা। তাই একটি জাতি কতখানি সভ্য, কতখানি অগ্রগতি অর্জন করবে তার মানদণ্ড হলো সেই জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষার সার্বিক অবস্থা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের চার দশক পরেও যুগোপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারে নি। সুষ্ঠু ও সুন্দর শিক্ষাঙ্গণ গড়ে তুলতে পারে নি। ফলে বাংলাদেশ তার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি অর্জনে সক্ষম হয় নি। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এখনও পশ্চাৎপদতার যে কালিমা লেগে আছে তার মূলে রয়েছে আমাদের অনুন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গণের অবস্তিকর পরিবেশ।

শিক্ষাঙ্গণের সংকট :

আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে সঠিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাঙ্গনে সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে শিক্ষানীতির অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নকল প্রবণতা, ছাত্ররাজনীতি ও সন্ত্রাস, অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ, সেশনজট, প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক সংকটের মুখে পড়বে।

শিক্ষানীতির অভাব :

বাংলাদেশে এখনও কোনো সস্থায়ী ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি কার্যকর হয় নি, যার আলোকে গোটা জাতিকে আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মতো শিক্ষিত করে তোলা যাবে। স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষানীতি প্রণয়নের যে বিচ্ছিন্ন প্রয়াস চলেছে রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চলছে সেই ঔপনিবেশিক ধারারই আদলে।

অবকাঠামোগত দুর্বলতা:

আমাদের দেশে জনসংখ্যা ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অপ্রতুল। প্রতিবছর জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু তার সাথে সঙ্গতি রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া যাচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের অবস্থাই জরাজীর্ণ। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবেই শিক্ষার্থীদের জনাকীর্ণ পরিবেশে পড়ালেখা করতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা খুবই কম। ফলে সুষ্ঠু পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নোট বই বা মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত মানুষ শিক্ষাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আসছে না।

নকল প্রবণতা:

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হলো নকল প্রবণতা। পড়ালেখা ছাড়া নকলবাজির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে সার্টিফিকেট লাভের এক ধরনের ঘৃণ্য ঝোঁক শিক্ষার্থীদের মধ্যে জেঁকে বসেছে। ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে উদ্ভূত নকল প্রবণতা আজো থামে নি। এই নকলবাজিতে অভিভাবকসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকবৃন্দও জড়িয়ে পড়েছেন। কাজেই নকলের অশুভ ছায়া সহজে শিক্ষাঙ্গণ থেকে সরছে না।

ছাত্ররাজনীতি ও সন্ত্রাস :

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি সরাসরি জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। জাতীয় ক্ষেত্রে যে অপরাজনীতির প্রসার ঘটেছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে শিক্ষাঙ্গণে। ফলে অনেক ছাত্র শিক্ষা উপকরণ ফেলে হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। প্রতিদিন রক্ত ঝরছে শিক্ষাকাণে। ছাত্ররা অসত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি প্রভৃতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষাঙ্গণে পড়ালেখার সুষ্ঠ পরিবেশ হারিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংঘাত ও হানাহানির কারণে সেশন জট সৃষ্টি হয়েছে।

অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ :

বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অর্থাভাবে পর্যাপ্ত কাঠামো গড়ে তোলা যাচ্ছে না। তদুপরি এ বরাদ্দের অর্থ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আশান্বিত প্রসার ঘটছে না। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক পদ সৃষ্টি, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে অর্থসংস্থান জরুরি।

অন্যান্য সমস্যা :

এছাড়া Drop out বা ঝরে পড়া, শিক্ষক রাজনীতি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ক্ষেত্রে বিপত্তি, শিক্ষকদের টিউশনি প্রবণতা, শিক্ষা সম্পর্কে জনগণের অসচেতনতা, প্রশিক্ষণের অভাব, কর্মমুখী শিক্ষার অভাব প্রভৃতি সমস্যা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কতিপয় নাজুক দিক।

যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন :

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীতব্য এ শিক্ষানীতিতে সর্বজনীন শিক্ষা, বাস্তব জীবনঘনিষ্ঠ কর্মমুখী শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি :

শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিসহ বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর উন্নতি সাধন করতে হবে। পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহসহ অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে।

শিক্ষাজ্ঞাণ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল :

সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে শিক্ষাঙ্গণ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল ও শিক্ষাকালে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে আন্তরিক হতে হবে। প্রয়োজনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

নকলরোধে উদ্যোগ গ্রহণ :

নকলবাজির মতো ঘৃণ্য ও ক্ষতিকর প্রবণতাকে নির্মূল করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অধিকতর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে আরও দক্ষ ও আন্তরিক হতে হবে। রাজনৈতিক মহলকেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি :

শিক্ষাঙ্গণে বিরাজমান বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলা করা সরকারের একার পক্ষে দুরূহ। এক্ষেত্রে সচেতন মহলসহ আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সন্ত্রাস ও নকলবাজি রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 'ঝরে পড়া' সমস্যা মোকাবেলায় শিক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনতা জরুরি। তাছাড়া ধনাঢ্য ব্যক্তিদের শিক্ষাবিস্তারে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানে উৎসাহী হতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে প্রচার ও গণমাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাতে হবে কার্যকরভাবে।

উপসংহার :

সাম্প্রতিককালে সরকার শিক্ষাবিস্তার ও শিক্ষার আধুনিকীকরণে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। স্কুল পর্যায়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান পাঠ্য করা, শিক্ষা উপবৃত্তি চালু, দূরশিক্ষণের মতো ব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়। তবে সার্বিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি করার জন্য আরও অনেক যুগোপযোগী কর্মসূচি হাতে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।