প্রবন্ধ রচনা: বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন | জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশে এর প্রভাব

জলবায়ুর পরিবর্তন ও বাংলাদেশে এর প্রভাব

এছাড়াও আরো যে বিষয়ে লিখতে পারবে:
👉🏻বিশ্ব জলবায়ুর পরিবর্তন
👉🏻বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশ
👉🏻বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন
👉🏻জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব
👉🏻জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ
👉🏻জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

ভূমিকা :

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ আস্তে আস্তে গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ । একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে মানবজাতি যখন সভ্যতার চরম শিখরে , ঠিক তখনই পরিবেশ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে মহা বিপর্যয়ের দিকে । বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় । বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সরকারই স্বীকার করেছে , জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক উষ্ণতা মানবজাতি এবং প্রকৃতির জন্য হুমকি । শুধু ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ( IGPC ) ' র গবেষণা নয় , বরং বহু আগে থেকে বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনগুলো উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবের কথা বলে আসছে । ফলে পৃথিবী এক ভয়াবহ সংকটময় অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । সারা বিশ্বে পরিবেশবাদী মানুষ ও সংগঠন জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়ে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইছে । সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশ , মালদ্বীপ , নেপাল ও আফ্রিকার দেশসমূহের মানুষ ও পরিবেশবাদী সংগঠন তাদের রাজনৈতিক নেতাদের কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য চাপ দিয়ে আসছে । জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হলে বাংলাদেশসহ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতাসম্পন্ন দেশসমূহ একদিন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে ।

জলবায়ু :

কোনো স্থানের কোনো বিশেষ সময়ের বায়ুর তাপমাত্রা , বায়ুপ্রবাহ , বৃষ্টিপাত , বায়ুচাপের মিলিত অবস্থাকে সে স্থানের সে সময়ের আবহাওয়া বলা হয় । আবহাওয়ার সতত পরিবর্তন ঘটে । কেননা বায়ুর উষ্ণতা, চাপ , বৃষ্টিপাত , আর্দ্রতা সবসময় একরূপ থাকে না । আর পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে কোনো খানের বায়ুর তাপ , চাপ , বৃষ্টিপাত , বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদির ২৫ বা ৩০ বছরের গড় অবস্থাকে সে স্থানের জলবায়ু বলে ।

জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগ:

সাধারণভাবে জলবায়ুকে সমভাবাপন্ন জলবায়ু , চরমভাবাপন্ন জলবায়ু , নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু , আর্দ্র জলবায়ু , শুষ্ক জলবায়ু , সামুদ্রিক জলবায়ু ইত্যাদি কতিপয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় । এজন্য এলাকাভেদে জলবায়ুর তারতম্য লক্ষ করা যায় । তবে এলাকা বা প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা দ্বারা পৃথক করা সম্ভব নয় । একটি বিভাগ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে অন্য বিভাগের সাথে মিশে গিয়েছে । অস্ট্রিয়ার গ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান ভূগোলবিদ ও ভ্লাডিমির কোপেন বিজ্ঞানসম্মতভাবে ১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বের জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগ করেন । ড . কোপেন সর্বপ্রথম পৃথিবীর জলবায়ুকে প্রধানত ৫ টি ভাগে ভাগ করে তাদের যথাক্রমে B, C , D , E এবং F নামক ৫ টি ইংরেজি বড় অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করেন । যেমন , B- বৃষ্টিযুক্ত ক্রান্তীয় জলবায়ু । C- শুষ্ক জলবায়ু , D - বৃষ্টিবহুল নাতিশীতোষ্ণ বা মধ্য অক্ষাংশীয় জলবায়ু । E- শীতল তুষার অরণ্য জলবায়ু , F- মেরুদেশীয় জলবায়ু । এছাড়া থর্নওয়েট জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগ করেন ।

জলবায়ুর পরিবর্তন :

জলবায়ুর চিরাচরিত অবস্থায় ও আচরণে লক্ষণীয় অসামঞ্জস্য দেখা দেওয়াকে বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তন। গত শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসে বিশ্বের পরিবেশবিদগণ লক্ষ করেন যে , সারা বিশ্বের জলবায়ুর ক্ষেত্রে বহু ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে । এ পরিবর্তনের অন্যতম দিক হচ্ছে , বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা আবাহাওয়া মণ্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধি , ঋতুচক্রের শৃঙ্খল ভেঙে যাওয়া বা ঋতুবৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন , অতিবৃষ্টি , অনাবৃষ্টি , অকালবন্যা , সামুদ্রিক ঝড় , দাবানল , সর্বোপরি সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতির প্রাকৃতিক অবক্ষয় ।

জলবায়ু বিবর্তন বা পরিবর্তনের প্রমাণ :

সৃষ্টির ঊষালগ্ন হতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় । পাললিক শিলার প্রকৃতি হতে পৃথিবীর অতীত কালের জলবায়ু সম্পর্কে ধারণা অর্জন করা সম্ভব । হিমবাহ দ্বারা সজ্জিত শিলাচূর্ণ হতে অতীতে হিমবাহ সংশ্লিষ্ট জলবায়ুর আভাস পাওয়া যায় । সাধারণত জিপসাম ও লবণ খনির অস্তিত্ব অতীতের শুষ্ক জলবায়ুর অবস্থান উল্লেখ করে । তবে চুনাপাথরের অস্তিত্ব হতে উষ্ণ জলবায়ুর প্রমাণ মেলে । অতীতকালের স্বাভাবিক জলবায়ু ছিল মৃদুভাবাপন্ন । সিলুরিয়ান , নিম্ন কার্বনিফেরাস , জুরাসিক , ইয়োসিন প্রভৃতি ভূতাত্বিক যুগে পৃথিবীর জলবায়ু স্বাভাবিক ছিল । বর্তমানকালের তাপ বলয়গুলো সুদূর অতীতে মেরু অঞ্চলের দিকে অধিক সস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ :

মানুষ নিজেই স্বপ্নময় পৃথিবীকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে । পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে , জলবায়ুর অস্বাভাবিক গতিপ্রকৃতির পেছনে মানুষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে । আইয়াপেটাসের পুত্র টাইটান প্রমিথিউস অ্যাপোলোর অগ্নিরথ থেকে আগুন নিয়ে মানুষকে আগুনের ব্যবহার শিখিয়েছেন । অক্সিজেন ( O ) ) এই আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে । পৃথিবীতে যত আগুনের ব্যবহার হবে ততই অক্সিজেন কমতে থাকবে । বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের পরিমান ২০.৭১ ভাগ , কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে । এর বিরূপ প্রভাব পৃথিবীর জলবায়ুর উপর পড়ছে । পৃথিবীকে বেষ্টনকারী আবহাওয়ামণ্ডলে ‘ ওজোন স্তর ' নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী বিদ্যমান , যা পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি প্রবেশ রোধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূন্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে । কিন্তু মানবসৃষ্ট দূষণ ও গৃহস্থালি পণ্য যেমন - ফ্রিজ , এয়ারকন্ডিশনার , বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সিএফসি ( ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ) গ্যাস , শিল্প বর্জ্য , কল - কারখানা ও যানবাহনের ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন ডাই - অক্সাইড , নাইট্রাস অক্সাইড , মিথেন গ্যাস দ্বারা প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী , ওজোনস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । একদিকে পরিবেশ দূষণ এবং অন্যদিকে বনভূমি উজার করার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাই - অক্সাইড শোষিত হচ্ছে না । আর এসব কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এবং ওজোনস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে , উতপ্ত হচ্ছে পৃথিবী । বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি :

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি । বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ভূ - পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় । এই বর্ধিত তাপমাত্রার ফলে হিমালয় পর্যন্ত , উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর গ্রিণল্যান্ড , অ্যান্টার্কটিকাসহ অন্যান্য ভূ - ভাগের সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে । বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব - দ্বীপ , যেখানে অসংখ্য নদনদী বয়ে চলেছে । পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ ° সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ ভূমি সমুদ্র গর্বে বিলীন হয়ে যাবে । এর ফলে ৫৫ মিলিয়ন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে । বাংলাদেশে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ৭ মি.মি. হারে বাড়ছে , যেখানে ভূ - পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৫-৬ মি.মি. / বছর । যার ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ১-২ মি.মি. / বছর । Intergovernment Panel of Climate Change ( IPCC ) - এর এক সমীক্ষায় বলা হয় , বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি দশকে ৩.৫ থেকে ১৫ মি.মি. বৃদ্ধি পেতে পারে । এমনকি ২১০০ সাল নাগাদ তা ৩০ সে.মি. এ পৌঁছাতে পারে ।

জীববৈচিত্র ধ্বংস :

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে । উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বনজঙ্গল ধ্বংসের ফলে বিভিন্ন প্রজাতি আজ বিলুপ্তির পথে । কারণ প্রতিকূল আবহাওয়ার সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না । বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ও জীবজন্তুর আসাবভূমি সুন্দরবন । পরিবেশ ও ভূমি - বিজ্ঞানীদের মতে , সমুদ্রের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের প্রায় ৭০ ভাগ তলিয়ে যাবে । যার ফলে বনজ পরিবেশ পড়বে চরম বিপর্যয়ে।

সুপেয় পানির সংকট :

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে । আইলা দুর্গত মানুষকে এখনো পানির সন্ধানে পার্শ্ববর্তী এলাকায় যেতে হচ্ছে । সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উপকূলের প্রায় সব এলাকার নদী - খালবিল - পুকুর - জলাশয়ে পানির প্রবাহ সৃষ্টি করেছে । ফলে সেখানে মিঠা পানির প্রকট অভাব দেখা দিয়েছে ।

অতিবৃষ্টি , অনাবৃষ্টি ও দাবানল :

জলবায়ুর পরিবর্তনে একদিকে যেমন অতিবৃষ্টি হচ্ছে অন্যদিকে তেমনি অনাবৃষ্টিতে দীর্ঘস্থায়ী খরার প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে । এতে ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । আর অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বনাঞ্চলে আকস্মিক আগুন লেগে যাচ্ছে । যুক্তরাষ্ট্র , অস্ট্রেলিয়া , কানাডা , জাপান , প্রভৃতি দেশে দাবানল জনগণের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে ।

নদনদীর প্রবাহ হ্রাস ও নদীভাঙন :

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ । কৃষির জন্য প্রয়োজন মৃদু পানির । উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হবে । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্যতম একটি সমস্যা দেখা দেবে সেটি হলো নদীভাঙন । অতিরিক্ত নদীভাঙনের ফলে মেঘনা ও পদ্মার তীরবর্তী এলাকাসমূহের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী সর্বষাপ্ত হয়ে পড়ছে । IPCC- এর এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে , প্রতি দুই সেন্টিমিটার উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় তটরেখা গড়ে ২-৩ মিটার স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হবে । ফলে ২০৩০ সাল নাগাদ মূল ভূ - পৃষ্ঠের ৮০-১২০ মিটার পর্যন্ত অতিক্রম করবে ।

সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস :

পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রাও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে । এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতাও বেড়ে যাবে । সাম্প্রতিক সময়ের ' সিডর ' ও ' আইলা ' তারই ফলাফল । পরিবেশ দূষণের কারনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী । মানুষের সৃষ্ট দূষণের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টি হয়েছে , তা বাংলাদেশের জন্য খুবই মারাত্মক । অবশ্য এর দায়ভার সবচেয়ে বেশি ধনী দেশগুলোর । অনেক ধনী রাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ' কিয়োটো প্রটোকল , ১৯৯৭ ' কার্যকর করে নি ।

বন্যা :

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘনঘন বন্যা সংঘটিত হয় । মৌসুমি বন্যা , জোয়ারভাটাজনিত , অতিবৃষ্টি জনিত বন্যার পাশাপাশি আকস্মিক বন্যা পৃথিবীর জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বের প্রায়ই অধিকাংশ দেশই এর শিকার হচ্ছে ।

লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ :

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে । ভূমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে । পরিণতিতে সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে । মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে ।

ঋতুচক্রে পরিবর্তন :

আষাঢ় মাসে এখন আর বৃষ্টি খুব একটা দেখা যায় না । তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি এলাকাতেই সময়মতো ঋতু শুরু হয় না । বর্ষাকালে বৃষ্টি নেই , শীতকালে শীত নেই আবার বসন্তকালে মনে হয় গ্রীষ্মকাল । ঋতু দেরিতে আসে আবার দেরিতে বিদায় নেয় । ফলে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয় ।

বালাদেশের জলবায়ু

বাংলাদেশের অবস্থান নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে । গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ ° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম ২১ ° সেলসিয়াস । শীতকালে সর্বোচ্চ ২৯ ° সেলসিয়াস সর্বনিম্ন ১১ ° সেলসিয়াস বর্ষাকালের গড় তাপমাত্রা ২৭ ° সেলসিয়াস থাকে। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ২৬.০১ ° সেলসিয়াস এবং গড় বৃষ্টিপাত ২০৩ সেন্টিমিটার । শীত , গ্রীষ্ম ও বর্ষা - এ তিনটি ঋতু এদেশে চরমভাবাপন্ন ।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব :

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে । ২০০৭ সালে জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের ( আইপিসিসি ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল , ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়বে । ফলে বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ পানি নীচে তলিয়ে যাবে । এর ফলে প্রায় ৫ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে । খরা , বন্যা , অতিবৃষ্টি , নদীভাঙ্গন , সামুদ্রিক ঝড় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে । সিডর আইলা , নার্গিসের ক্ষতচিহ্ন এখনও শুকায় নি । ২০০৯ সালের ২৩ জুন দেশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় । ২০০৯ সালের ২৮ জুন মাত্র ৬ ঘণ্টায় দেশে ৩৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় । উত্তরবঙ্গে এদেশে সময়মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে না । সময়মতো শীত আসছে না আবার প্রায় সারা বছরই গ্রীষ্মের দাবদাহ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের তেমন হাত না থাকলেও বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে । জলবায়ু পরিবর্তনে যে সিএফসি গ্যাস দায়ী তার শতকরা ৮৫ ভাগই উৎপন্ন করে উন্নত দেশগুলো । বাংলাদেশ বিশ্বের বার্ষিক উৎপন্ন সিএফসি গ্যাসের মাত্র ০.০২ শতাংশ উৎপাদন করে । তবে ২১ এপ্রিল ২০১০ তারিখে সিইজিআইএস কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের এত শঙ্কিত হবার কোনো কারণ নেই । তবে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে এখনই সময় বিশ্বকে এক হওয়া নয়ত , অদূর ভবিষ্যতে মালদ্বীপের মতো দেশগুলো পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ।

জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন ও বাংলাদেশ :

কোপেনহেগেনে ৭ ডিসেম্বর ২০০৯ শুরু হওয়া জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে ১৯৩ দেশ অংশগ্রহণ করে । ১৯ ডিসেম্বর একটি অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষরের মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হয় । এতে উন্নত দেশ অঙ্গীকার করে যে , তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ৩০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিবে । পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য । দরিদ্র দেশগুলোকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল । বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়ায় ১৫ শতাংশ সাহায্যের আশা করছে ।

জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীদের নতুন তথ্য :

বাংলাদেশ সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের ( সিইজিআইএস ) বলেছে , হিমালয় পর্বতমালা থেকে প্রতিবছর ১০০ কোটি টন পলি বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ে । সমুদ্রের জোয়ার - ভাটার টানে তা বাংলাদেশের উপকূলে এসে জড়ো হয়ে নতুন ভূমি গঠন করে । এভাবে গত ৬৫ বছরের বাংলাদেশের উপকূলে এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি জেগে উঠেছে । ফলে সমুদ্রের পানি বেড়ে গেলেও উপকূলীয় এলাকায় পলি পড়ার ফলে ভূমির স্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব এলাকা সমুদ্রে বিলীন হবে না ।

উপসংহার :

পৃথিবীকে বসবাস যোগ্য করে রাখার দায়িত্ব মানুষের । অথচ মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দ্বারা পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে । কেননা মানুষ একদিকে সভ্যতার চরম শিখরে আরোহন করছে আর অন্যদিকে পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে । তাই মানুষকে যার যার নিজের অবস্থান থেকে পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতন ও কৌশলগতভাবে অবস্থানের মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীকে রক্ষা করতে হবে ।


আরো পড়ুন: