প্রবন্ধ রচনা: জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য

জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের তাৎপর্য

এছাড়াও আরো যে বিষয়গুলো সম্পর্কে লিখতে পারবে:
👉১৬ ই ডিসেম্বর
👉বিজয় দিবসের তাৎপর্য
👉বিজয় দিবস
👉আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম

ভূমিকা :

বাঙালি জাতির জীবনে যেসব দিবস রয়েছে তন্মধ্যে বিজয় দিবস খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে । ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ - এর এই দিনে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বিজয় । এই দিনে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ । তাই ' বিজয় দিবস ' আমাদের আত্মমর্যাদার ও আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক ।

পটভূমি :

বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পটভূমিতে রয়েছে বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস । সে ইতিহাসের এক গৌরবময় মাইলফলক মহান ভাষা আন্দোলন । এই আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্যদিয়ে বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে । পরে দীর্ঘ দুই দশক ধরে চলে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী জঙ্গিবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন - সংগ্রাম । এ পটভূমিতেই ১৯৭১ - এর ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীনতা । পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বীর বাঙালি । শুরু হয় এদেশে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ । দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলে মুক্তিসেনাদের সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ । যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালি জীবন বিসর্জন দেয় । অবশেষে ১৯৭১ - এর ১৬ ই ডিসেম্বর বাঙালির বিজয় সূচিত হয় । এই দিনে ঢাকায় ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ) ঘটে ইতিহাসের অন্যতম গৌরবময় ঘটনা — পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নিচু করে অস্ত্র মাটিতে ফেলে আত্মসমর্পণ করে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে ।

বিজয় দিবসের তাৎপর্য :

ত্রিশ লক্ষ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা । অনেক অশ্রু বিসর্জনে পাওয়া এ স্বাধীনতা আমাদের কাছে অত্যন্ত গৌরবের । প্রজন্মের পর প্রজন বয়ে নিয়ে চলেছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পতাকা , গাইছে বিজয়ের গৌরবগাথা । তাই বিজয় দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম । প্রতিবছর এই দিনটি পালনের মাধ্যমে আমরা নতুন প্রজনকে এবং বিশ্বকে বার বার মনে করিয়ে দিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা , বীর শহিদদের কথা । আমরা অনুপ্রাণিত হই আমাদের দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা স্মরণ করে । উদ্বুদ্ধ হই অগ্রগতির পথযাত্রায় এগিয়ে যেতে । বিজয় দিবস আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের একটি দিন হলেও এর সাথে জড়িয়ে আছে ৭১ - এর মহান শহিদদের স্মৃতি , স্বজন হারানোর আর্তনাদ আর যুদ্ধাহত ও ঘরহারা মানুষের দীর্ঘশ্বাস । এ দিনটি শুধু আমাদের বিজয়ের দিন নয় , এটি আমাদের চেতনার জাগরণের দিন । তাই এই দিনে প্রতিটি বাঙালি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দেশকে গড়তে — বিশ্বসভায় সামনের সারিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে ।

বিজয় দিবস উদ্‌যাপন :

বাঙালি জাতির এ আনন্দের দিনটি নানাভাবে উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে । সেদিন বাঙালিরা মিলিত হয় প্রাণের মেলায় । দেশের সকল সরকারি - বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ওড়ে আমাদের লাল - সবুজের পতাকা । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান , স্কুল , কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান । রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম , সরকারি - বেসরকারি টিভি চ্যানেল গ্রহণ করে নানা উদ্যোগ । সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র । বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে ওড়ে পতাকা । দেশের সর্বস্তরের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তাদের বীর শহিদদের । বিজয়ের আনন্দে মানুষ স্মরণ করে এ দিনটিকে ।

বিজয় দিবস ও বর্তমান বাস্তবতা :

শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হলেও আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবের আঘাতে আজ ছিন্নভিন্ন । মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেক কিছুই এখন চলে গেছে আড়ালে । গণতন্ত্র এখন সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে । অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এখন স্বপ্ন বিলাসিতা । সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ হয়েছে পরিত্যক্ত । আর মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা বিভেদ ও সংঘাতে পর্যবসিত । এ অবস্থা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে বিজয় দিবস এখনও আমাদের অনুপ্রাণিত করে ।

বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রাপ্তি :

অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আমাদের প্রাপ্তি অনেক । স্বাধীন বাংলাদেশ এখন শিক্ষায় যথেষ্ট এগিয়েছে । দেশের বাইরেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে । যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি , পল্লি জনপদে বিদ্যুতায়ন , স্বাস্থ্য খাতসহ ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেছে । ক্রীড়া ক্ষেত্রেও সুখ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ । বিশেষ করে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি দিন দিনই বাড়ছে । তৈরি পোশাক , চামড়া , হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদির পর এবার জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে ।

অনুষ্ঠানমালা :

মহাসমারোহে বিজয় দিবস উদযাপিত হয় । এ দিন সারাদেশ ছেয়ে যায় লাল - সবুজের সাজে । বাড়ির ছাদে , দোকানে , রাস্তার পাশে , গাড়ির সামনে , স্কুল - কলেজে , এমনকি রিকশার হ্যান্ডেলেও শোভা পায় লাল - সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা । প্রতিটি শহরে পরিলক্ষিত হয় উৎসবের আমেজ । রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী আয়োজন করে গণমুখী নানা অনুষ্ঠানের । স্বাধীনতার আবেগে উদ্বেলিত নরনারী উৎসবের সাজে সেজে সেখানে জমায়েত হন । স্কুল - কলেজে ছাত্রছাত্রীরা নানারকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে । এদিন সকালবেলা ঢাকার জাতীয় প্যারেড ময়দানে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয় । রাষ্ট্রপতি , প্রধানমন্ত্রী , মন্ত্রিসভার সদস্য , কূটনীতিবিদ , গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এই কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন । চট্টগ্রামে বিজয় দিবস উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিজয় মেলার আয়োজন করা হয় । চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই মেলা দেখতে আসেন । দেশের প্রতিটি জেলায়ও উৎসবমুখর পরিবেশে এই দিনটি পালিত হয় ।

উপসংহার :

১৬ ই ডিসেম্বর চির প্রদীপ্ত একটি মহিমান্বিত দিন । আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটি অবিস্মরণীয় প্রভাব বিস্তার করে আছে । শহিদের মহান আত্মত্যাগের এ দিনটি যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি দিনটি সত্য ও ন্যায়ের পথে মাথা তুলে দাঁড়াবারও । এটি আমাদের চেতনার জাগরণের দিন । তাই এ দিনটিকে আমরা সগর্বে স্মরণ করব ।