একুশের চেতনায় '৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধ | প্রবন্ধ রচনা
একুশের চেতনায় '৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধ
ভূমিকা :
বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল ও শ্রেষ্ঠ অধ্যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ । ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়লাভের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে । এই মুক্তিযুদ্ধ কোনাে ইতিহাসবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । এর রয়েছে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট । ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নবজাগ্রত জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়েছিল , তাই পরবর্তী নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করে । ফল হিসেবে বিশ্ব - মানচিত্রে স্বাধীন - সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র নামে স্থান করে নেয় ।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা :
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক অধ্যায় । একুশের চেতনার জন্ম হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে । জাতিগত , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে । তদানীন্তন পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা মাত্র সাতজনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী । ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দেওয়া হয় । প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলা । বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পুঞ্জীভূত হতে থাকে ক্ষোভ । এরপর থেকে ক্রমে জোরালাে হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি । ক্রমান্বয়ে তা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে ।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট :
১৯৫২ সালের শুরুতে আন্দোলন তীব্ৰআকার ধারণ করে । ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাষ্ট্রভাষা দিবস ’ ও সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত হয় । পাকিস্তান সরকার আন্দোলন দমন করার জন্য ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে জনসমাগম , জনসভা ও মিছিল নিষিদ্ধ করে দেয় । ছাত্ররা সংগঠিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অগ্রসর হলে তাদের ওপর পুলিশ গুলি চালায় । শহীদ হন সালাম , রফিক , জব্বার , সফিউর , বরকতসহ নাম না - জানা অনেকে । প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সারা পূর্ব বাংলা । পরদিন সারারাত জেগে শহীদদের স্মরণে গড়া হয় শহীদ মিনার । পুলিশ তা ভেঙে ফেললে আবারও গড়ে তােলা হয় । এ শহীদ মিনার একুশের শােক , সংগ্রাম ও শপথের প্রতীক । যা অসাম্প্রদায়িক , গণতান্ত্রিক , প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনে ।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি :
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ - উদ - দৌলা ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন । অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য । প্রায় দুইশ ’ বছরের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন - শােষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হয় বাংলাসহ গােটা ভারতবর্ষ । শুরু হয় ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন । দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক ‘ দ্বি - জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যথাক্রমে ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্রের ।
স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ববাংলা অংশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে জন্ম নেয় ; যা আজকের বাংলাদেশ । পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখে স্বাধীনতা ও মুক্তির । কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন অচিরেই ভঙ্গ হয় । বাঙালি শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে আরেক ঔপনিবেশিক শাসন - শােষণের । পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গের বৈষম্যমূলক শাসন ও শােষণে নিপীড়িত হয় বাংলা । ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ইতিহাস পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালির শােষিত হওয়ার ইতিহাস । বাঙালি জাতির বঞ্চনার ইতিহাস । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়- ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর - নারীর আর্তনাদের ইতিহাস । বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস ।
একুশের চেতনা :
একুশ মানে মাথা নত না করা । একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের রাজনীতি , অর্থনীতি , সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক তীব্র আলােড়ন তুলেছিল । বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ , অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ , গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ এবং শােষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন রচনায় বাঙালিকে সাহস জুগিয়েছে ভাষা আন্দোলন । নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুর্বলের সম্মিলিত ও সাহসী রুখে দাঁড়ানােই একুশের চেতনার মূলকথা । পাকিস্তানি কায়েমি শাসকগােষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া উর্দুকে বাঙালি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়নি । রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'- দাবিতে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিতেও তারা পিছপা হয়নি । সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার অন্যায়কে তারা রুখে দিয়েছে । ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে । তাই একুশের মূল শিক্ষাই হলাে , সকল ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা । শােষণ , সাম্প্রদায়িকতার শিকড় উপড়ে গণতান্ত্রিক ও সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা ।
৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে একুশের ভূমিকা :
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষা ও সংস্কৃতির পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না । পরবর্তী কালে বাংলাদেশের স্বাধিনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছে । উন্মেষ ঘটিয়েছে সংগ্রামী বাঙালিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ হতে এবং সকল অন্যায় , শােষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে । '৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে একুশের চেতনার ভূমিকা নিচে তুলে ধরা হলাে :
১. পরাধীন বাঙালিকে নিজস্ব অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তােলে । বাঙালি তার ন্যায্য দাবি আদায়ে আপসহীন হয়ে ওঠে ।
২. ভাষা আন্দোলন বাঙালির মধ্যে এক অভূতপূর্ব ঐক্য ও সংহতি তৈরি করে ;
৩. বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক । এই আন্দোলনের পর বাঙালি নিজের জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয় ;
৪. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রেরণাই পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন , ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন , ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন , ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন , ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য ও বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ।
৫. একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালিকে তার ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করে তােলে । বাংলা ভাষার গবেষণা , চর্চা ও বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি । যা আজ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার বাতিঘর ।
৬. ভাষা আন্দোলন বাঙালির মাঝে এক সুদৃঢ় অসাম্প্রদায়িক চেতনা জন্ম দেয় । পরবর্তী সময়ে মুসলমান হিন্দু - বৌদ্ধ - খ্রিস্টান নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনে ।
উপসংহার :
কোনাে কোনাে মহান দিন নিয়ে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা । বাঙালিজাতির জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনই একটি ঐতিহাসিক ও মহান দিন । বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মরণীয় এই দিনটি বাঙালির ইতিহাসে দেপীপ্যমান এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর । মূলত এই ভাষা আন্দোলনকে ঘিরেই বাঙালি জাতি আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে । প্রায় তিন দশকের আন্দোলন - সংগ্রামের চড়াই - উৎরাই অতিক্রম করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের নিবন্ধগুলিতে মন্তব্য করার সময় দয়া করে শ্রদ্ধাশীল এবং গঠনমূলক হন। অনুপযুক্ত, আপত্তিকর, বা অফ-টপিক মন্তব্য মুছে ফেলা হবে। আসুন ABC আইডিয়াল স্কুলের সকল পাঠকদের জন্য একটি ইতিবাচক এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ বজায় রাখি। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ!