প্রবন্ধ রচনা: একটি ঝড়ের রাত

একটি ঝড়ের রাত

সূচনা:

১৯৬৮ সালের ঝড়ের কথা আমরা কখনাে ভুলব না । সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের তাণ্ডবলীলা অনেকের মনে আজও বিষাদের স্মৃতি হিসেবে বিরাজমান । জীবনের অনেক ছােট - খাট ঝড়ের কথা মনে আছে , কিন্তু সেদিনের ঝড়ের যে তাণ্ডব রূপ ছিল , তার সাথে আর কোনটির তুলনা মেলা ভার ।

ঝড়ের পূর্বাভাস:

তখন আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় । বেলা দ্বিপ্রহর পর্যন্ত আকাশ ছিল নীল । আকাশে কোথাও মেঘের চিহ্নমাত্র ছিল না , কিন্তু দুপুরের পর হতে হঠাৎ আকাশের চেহারা পাল্টে গেল । সমস্ত অ'কাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে না আসতেই মেঘ বেশ জমাট বেঁধে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করল । নক্ষত্রখচিত আকাশ আর নেই , চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । ইতিমধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল । সেই সাথে বাতাসের বেগও ক্রমে বাড়তে লাগল । রাত ৮ টার দিকে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি । বােধ হয় , বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল । তাই রেডিওতে নদী - বন্দরগুলোর জন্য বিপদ সঙ্কেতের কথা বার বার ঘােষণা করা হচ্ছিল , কিন্তু তদসত্ত্বেও দেশের উপর দিয়ে এমন এক প্রলয়ঙ্করী প্রবল ঝড় বয়ে যাবে , তা ধারণাই করা অসম্ভব ছিল, আর এ কারণে মনে এতটুকু শঙ্কাও তখন পর্যন্ত জাগেনি ।

ঝড়ের বিবরণ:

রাত তখনাে তেমন গভীর হয়নি । বৃষ্টির বেগ ইতােমধ্যে কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল , কিন্তু বাতাসের বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল । এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ শােনা গেল । রাত প্রায় এগারটার দিকে শুরু হল ঝড়ের মহাতাণ্ডব নৃত্য । মুহুর্মুহু মেঘের গর্জন আর সেই সাথে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ । দু ’ কান যেন তালা লেগে গেল । বৃষ্টির ঝাপটা , বাতাসের তােলপাড়ে মনে ভীতির সঞ্চার হল । বাইরে কি ঘটছে বুঝার উপায় নেই , কিন্তু মনে হল , মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে । আশে পাশের আর্ত চিঙ্কার , আজানের ধ্বনি , কাঁসার ঘন্টাধ্বনি , বিপন্ন মানুষের ক্রন্দন , হুটাহুটি , ছুটাছুটি সব মিলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হল । চারদিকে ঘাের অন্ধকার , কিছুই দেখার যাচ্ছে না । দরজা খুলে বাইরে যাবার উপায় নেই , জানালার ফাক দিয়ে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝলক চোখে এসে লাগছে , আর সেই সাথে শত শত রাক্ষসীর বিকট চিঙ্কারে পৃথিবী যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে । সাহস হচ্ছে না , তবু উৎসাহ দমিয়ে রাখতে পারলাম না । তাই কোন রকমে একটা জানালা খুলে ফেললাম । দেখলাম , ভীষণ বেগে ঝড় বইছে । মহাপ্রলয়ের শিঙ্গায় সমস্ত পৃথিবী যেন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে । ঠিক এমনি ভীতিকর মুহূর্তে হঠাৎ বিজলি বাতি নিভে গেল । আমার চেতনা ঠিক ছিল কি না জানি না , তবে অনুমান করলাম , আমাদের বৈঠকখানাটি এক দমকা হাওয়ায় উড়ে কোথায় যেন পড়ল । আমরা যে ঘরে ছিলাম , সে ঘরটিও তেমন মজবুত নয় । প্রতি মুহূর্তে ভয় হল , এখন বুঝি আমরাও তৃণের মত হাওয়ায় উড়ে যাব । এ ঘাের বিপদে এক স্রষ্টা ছাড়া আর কে - ই বা রক্ষা করতে পারে ? তাই ঘন ঘন সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে লাগলাম । ভয়ে নিজের অজ্ঞাতেই কখন খােলা জানালাটি আবার লাগিয়ে দিয়েছি , জানি না । হঠাৎ বিকট শব্দে জানালার কাছে কি যেন এসে ভেঙ্গে পড়ল । বােধ হয় , কোন ঘরের আস্ত টিনের চালাটি সেখানে এসে পড়ল । চারদিকে মট মট করে গাছপালা ভাঙ্গছে । নিজের ঘরের চালাটিও কয়েকবার ঝড়ে মড় মড় করে উঠল । একবার ভাবলাম , বের হয়ে পাশের স্কুলের দালানে আশ্রয় নিই , কিন্তু এ অবস্থায় বের হওয়াও বিপজ্জনক । তাই ক্ষান্ত হলাম । এভাবে কতক্ষণ কাটল , জানি না । তবে মাঝরাত যে পার হয়েছে , তাতে কোন সন্দেহ রইল না । এর কিছুপরে ঝড়ের প্রচণ্ডতা যখন কমে এল তখন মনের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির ভাব ফিরে পেলাম । রাতও আর বেশী নেই । উদ্বেগ আর তন্দ্রার মাঝে অবশিষ্ট রাত কাটিয়ে দিলাম ।

উপসংহার:

ভাের হতে না হতেই বের হয়ে পড়লাম । প্রকৃতির রুদ্র রূপ থেমে গিয়েছে বটে , কিন্তু চিহ্ন রেখে গিয়েছে । সামান্য বাড়ীর উঠান পার হওয়া কঠিন হয়ে পড়ল , কেননা স্তুপাকারে গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে আছে । রাস্তায় যত্রতত্র ডালপালা খড়কুটায় পরিপূর্ণ । আশেপাশে দেখলাম , অনেক তারের খুঁটি , কাঁচা বাড়ীঘর , টিনের চালা ইত্যাদি পড়ে রয়েছে । খবর পেলাম , বহুলােক হতাহত হয়েছে । প্রকৃতির রুদ্ররােষ যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে , পরদিন তা চাক্ষুষ দেখে শিউরে উঠলাম । শুনেছি , মৃত্যু অপেক্ষা মৃত্যুভীতি নাকি ভয়ঙ্কর । সেদিনের সে ঝড়ের রাতে মৃত্যুভীতি যে সত্যই ভয়ঙ্কর , তা আমি বাস্তবে প্রত্যক্ষ করলাম।