একটি নদীর আত্মকাহিনী প্রবন্ধ রচনা

একটি নদীর আত্মকাহিনী

আমি সুরমা । নাম শুনে তােমরা হয়তাে ভুল করে বসবে । আমি চোখে দেয়ার সুরমা ’ নই । আমি নদী , আমার নাম সুরমা । তবে তােমরা চোখে যে সুরমা ব্যবহার কর , তা অপেক্ষা আমি তােমাদের অনেক বেশী উপকারে লাগি । তােমাদের বাংলাদেশেরই এক প্রান্তে আমার বাস । তবে এক প্রান্তে বাস করলেও আমি গােটা বাংলাদেশের লোককে বড় ভালবাসি ও তাদের নানা উপকার করে থাকি । বিশ্বাস হয় না বুঝি ? তা হলে আমার জীবন কাহিনী পড়ে দেখ । আমি যে কত উপকার করে থাকি , আমার মত নদী না হলে যে এ দেশের মানুষের চলে না , তা আমার জীবন কাহিনী পড়লেই বুঝতে পারবে ।

আমার আদি নিবাস আসামে । কিন্তু আসাম আমার জন্মস্থান হলেও প্রতিবেশী বাংলাদেশ আমাকে বড় আকর্ষণ করে । বড় মনােরম এ বাংলাদেশ । এ দেশের মাটি বড় সরস লোকজন বড় সরল , বনবাদাড় , গ্রামগঞ্জ বড় সুন্দর । তাই এদেশ আমার কাছে বড় ভাল লাগে এবং এ দেশের মাটিতে বিচরণের জন্য আমার অদম্য ইচ্ছা জাগে । তাই জন্মের কিছুকাল পরে আমি আমার জন্মভূমির মাটি ছেড়ে বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করি । যেহানে আমি বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করি , সেস্থানের নাম জালালাবাদ বা শ্রীহট্ট । অবশ্য খুব সহজে আমি সেস্থানে ঢুকতে পারিনি । কি কৌশলে আমি সেখানে ঢুকেছি , সেকথা আজ আমি তােমাদেরকে বলছি ।

আসাম উপত্যকার দু পাশ দিয়ে দু'টি নদী বয়ে গিয়েছে । তার দক্ষিণ দিকেরটাই হলাম আমি । মণিপুরের উত্তর ধার দিয়ে যে পর্বতশ্রেণী উচু হয়ে হিমালয়ের সর্বশেষ পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছে তারই এক জায়গা হতে আমি একদিন সমতল ভূমিতে নেমে আসতে থাকি । দক্ষিণ - পশ্চিম দিকে আমার এ যাত্রা অত্যন্ত ধীরগতিতে হেলে দুলে চলতে থাকে । প্রায় ১৬০ কিলােমিটার পথ এমনিভাবে চলার পর সমতল ভূমিতে পৌছার আগ পর্যন্ত। আমার আরও একটি নাম আছে । এ নাম আমার যৌবনকালের ' সুরমা ' নাম নয় , বাল্যকালের ডাকনাম ‘ বরাক ' । ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলেও বাপ - মায়ের দেয়া আদুরে নামটি যেমন কেউ ছাড়তে চায় না , আমার এ নামটিও তেমনি । যদিও এ নামটি এখন আর আমার পছন্দ হয় না , তবু লােকে এ নামেই আমাকে ডাকে । এ নামে চলার পথে আমি মণিপুর হতে নাগা পাহাড়কে পৃথক করে দিয়েছি । ' বরাক নামে আমি আসামে কাছাড় জেলার ভেতর দিয়ে পথ চলছিলাম , কিন্তু বদরপুরের কয়েক কিলােমিটার পশ্চিমে ভাঙ্গার বাজার নামক স্থানে পৌছে আমি সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ি । এখান হতে সিলেটের দক্ষিণ দিকে আমার চলার পথকে লােকে ' সুরমা ' বলেই ডাকে ।

সুরমা নামে চলতে চলতে আমি আরাে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ি এবং মালিতে পৌছে আমার এক শাখা কুশিয়ারার সাথে আবার একত্রিত হই । এর কিছু পরে মেঘনা নামে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে এসে আমার এক পুরাতন বন্ধু ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হই । অবশ্য আমার এ পুরাতন বন্ধুর সাথে দেখা করতে আমাকে বিস্তর পথ চলতে হয়েছে । ইতােমধ্যে আমি প্রায় নয়শত পঞ্চাশ কিলােমিটার পথ পিছনে ফেলে এসেছি।

আমাকে যতখানি নিরীহ ও শান্ত মনে কর , আসলে আমি তত নিরীহ নই । শ্রীহট্ট জেলায় আমি তেমন গভীর নই । এজন্য চঞ্চলা মেয়ের মত আমি এখানে কিছুটা দুষ্টামিও করি । বলতে পার , আমি কতকটা ক্ষ্যাপা মেয়ের মত আচরণ করি । তবে বর্ষাকালে আমার মনমেজাজ বড় একটা ভাল থাকে না । এ সময় আমি যেন যৌবন লাভ করি , শরীরে যেন নতুন বল সম্ভার হয় , আর সেই আবেগে বনবাদাড় , মাঠঘাট , বাড়ীঘর , গাছপালা সবকিছু একেবারে ভাসিয়ে দেই । এতে অবশ্য আপাততঃ অনেকের দুঃখ - কষ্ট হয় বটে , তবে পরিণামে ফল তাদের পক্ষে ভালই হয় । মাঠেমাঠে প্রচুর ফসল ফলে । আমি মানুষের জন্য সওগাত হিসেবে যে পলি বহন করে আনি , তা মাটিকে উর্বর করে , আর তাতে মানুষের মঙ্গল হয় । যারা বেঁচে থাকে , তারা খেয়ে পরে সুখে থাকে ।

তােমরা মানুষজাত বড় ধৈর্যহীন । আমি যৌবনের আবেগে যখন উথলে উঠি , দু'কূল প্লাবিত করি , তখন তােমরা তা সহ্য করতে পার না । আমার পথে বাধ দিয়ে আমাকে দমন করতে বা ঠেকাতে চাও । ফেঞ্চুগঞ্জ হতে মানিককণা পর্যন্ত আমার চলার পাশে মাটির পাহাড় গড়ে তুলে আমাকে ঠেকাতে চেষ্টা করেছ , কিন্তু এতে তােমাদের কি লাভ হয়েছে ? আমাকে কতটুকু ঠেকাতে পেরেছ ? এ বৃষ্টি - বাদলের দেশে আমাকে কতটুকুই বা শান্ত করতে পেরেছ ? আমার যখন মর্জি হয় , তখন আমি শান্ত থাকি , যখন আবেগে ফেটে পড়ি , তখন বাঁধ ভেঙ্গে ছুটে চলি , তােমাদের সাথে দেখা না করে থাকতে পারি না।

আমি তােমাদের কি প্রয়ােজনে লাগি , সে কথাটি না বললে আমার জীবন কাহিনী অপূর্ণ থেকে যাবে । তাই প্রাসঙ্গিক কারণেই সেই কথাটা তুলছি । যখন রেল ছিল না , তখন আমিই ছিলাম বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের একমাত্র বাণিজ্যপথ । এখন রেল হয়েছে , জায়গায় জায়গায় আমার উপর সেতুও তৈরি হয়েছে , কিন্তু তাই বলে আমার প্রয়ােজন একেবারে শেষ হয়েছে , এমন কথা ভাবিও না । বর্ষার সময় বড় বড় জাহাজ নানা প্রকার পণ্যদ্রব্য নিয়ে আমার কুশিয়ারার উপর দিয়ে চলাচল করে । আমার দু'পাশ দিয়ে অসংখ্য ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে । বছরে বার মাস আমার শাখা - প্রশাখার উপর দিয়ে কত যে দেশী নৌকা পাল তুলে ভেসে বেড়ায় , তার হিসেব করা কঠিন । যেখানে আমি পাহাড় পর্বতের মধ্য দিয়ে চলাচল করি , সে সব স্থারে দু'পাশে সবুজ তরুলতা , গাছপালা গজিয়ে উঠেছে । এ সবুজ বনানীর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে , একটা আলাদা রূপ আছে , যা সকলের চোখ জুড়িয়ে দেয় , মনকে আনন্দে উৎফুল্ল করে । আমার সেই স্নিগ্ধ শ্যামল রূপটি তােমরা কেউ দেখতে আসলে আমি বড়ই খুশী হব।