গ্রাহামের সূত্র : গ্যাসের ব্যাপন ও নিঃসরণ - নবম-দশম শ্রেণি
গ্রাহামের ব্যাপন সূত্র: একটি বিস্তারিত আলোচনা
আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে গ্যাসের চলাচল অনুভব করি। কোনো সুগন্ধির বোতলের মুখ খুললে তার সুবাস যেমন সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি রান্নাঘরের গ্যাসের গন্ধও দ্রুত নাকে এসে পৌঁছায়। এই ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াটি হলো ব্যাপন। কিন্তু সব গ্যাস কি একই গতিতে ছড়ায়? হালকা গ্যাস এবং ভারী গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার হারের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর লুকিয়ে আছে স্কটিশ রসায়নবিদ টমাস গ্রাহামের যুগান্তকারী এক সূত্রের মধ্যে, যা গ্রাহামের ব্যাপন সূত্র (Graham's Law of Diffusion) নামে পরিচিত।
বিজ্ঞানী টমাস গ্রাহাম (১৮০৫-১৮৬৯)
টমাস গ্রাহাম ছিলেন একজন প্রখ্যাত রসায়নবিদ, যিনি ভৌত রসায়নের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। তিনি কলোয়েড (colloids) এবং ডায়ালাইসিস (dialysis) নিয়ে গবেষণার জন্য সর্বাধিক পরিচিত হলেও, গ্যাসসমূহের ব্যাপন এবং নিঃসরণ নিয়ে তাঁর কাজ রসায়নের জগতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৮৩১ সালে তিনি গ্যাসসমূহের ভৌত ধর্মের উপর ভিত্তি করে তাদের ব্যাপন হারের গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
ব্যাপন (Diffusion) ও নিঃসরণ (Effusion): মূল ধারণা
গ্রাহামের সূত্রটি বোঝার আগে দুটি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা আবশ্যক:
- ব্যাপন (Diffusion): কোনো মাধ্যমের মধ্যে উচ্চ ঘনত্বের স্থান থেকে নিম্ন ঘনত্বের স্থানে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় বস্তুর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাপন বলে।
- নিঃসরণ (Effusion): একটি পাত্রে আবদ্ধ গ্যাসকে একটি অতিক্ষুদ্র ছিদ্রপথে উচ্চচাপের অঞ্চল থেকে নিম্নচাপের অঞ্চলে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে নিঃসরণ বলে।
যদিও প্রক্রিয়া দুটি ভিন্ন, এদের পেছনের মূলনীতি একই—গ্যাসের অণুগুলোর গতি। তাই গ্রাহামের সূত্র ব্যাপন এবং নিঃসরণ উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
গ্রাহামের ব্যাপন সূত্রের মূল বক্তব্য
গ্রাহামের সূত্রটি বিবৃত করে যে:
"নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও চাপে, কোনো গ্যাসের ব্যাপন বা নিঃসরণের হার তার ঘনত্বের বর্গমূলের ব্যস্তানুপাতিক।"
এর অর্থ, যে গ্যাসের ঘনত্ব যত বেশি, তার ব্যাপন হার তত কম। আর যে গ্যাসের ঘনত্ব যত কম, তার ব্যাপন হার তত বেশি।
গাণিতিক রূপ ও ব্যাখ্যা
সূত্রটিকে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা যায়: $$ r \propto \frac{1}{\sqrt{d}} $$ যেখানে, \(r\) = গ্যাসের ব্যাপন হার এবং \(d\) = গ্যাসের ঘনত্ব।
আমরা জানি, গ্যাসের ঘনত্ব (\(d\)) তার আণবিক ভরের (\(M\)) সমানুপাতিক, অর্থাৎ \( d \propto M \)। তাই সূত্রটিকে আণবিক ভরের সাপেক্ষেও প্রকাশ করা যায়: $$ r \propto \frac{1}{\sqrt{M}} $$
দুটি ভিন্ন গ্যাসের জন্য সূত্রের প্রয়োগ
দুটি ভিন্ন গ্যাস, যেমন—গ্যাস 'A' এবং গ্যাস 'B'-এর ব্যাপন হার যথাক্রমে \(r_A\) ও \(r_B\) এবং তাদের আণবিক ভর যথাক্রমে \(M_A\) ও \(M_B\) হলে, গ্রাহামের সূত্রানুসারে তাদের সম্পর্কটি হবে: $$ \frac{r_A}{r_B} = \sqrt{\frac{M_B}{M_A}} $$ এই সমীকরণটি ব্যবহার করে দুটি গ্যাসের ব্যাপন হারের তুলনা করা যায়।
গাণিতিক উদাহরণ
প্রশ্ন: একটি লম্বা কাচনলের দুই প্রান্তে তুলা দিয়ে অ্যামোনিয়া (\( \text{NH}_3 \)) গ্যাস ও হাইড্রোজেন ক্লোরাইড (\( \text{HCl} \)) গ্যাস প্রবেশ করানো হলো। কোন গ্যাসটি দ্রুত ছড়াবে এবং কোথায় সাদা ধোঁয়ার বলয় তৈরি হবে?
সমাধান:
প্রথমে গ্যাস দুটির আণবিক ভর নির্ণয় করি:
- অ্যামোনিয়ার আণবিক ভর, \( M_{\text{NH}_3} = 14 + (3 \times 1) = 17 \) গ্রাম/মোল
- হাইড্রোজেন ক্লোরাইডের আণবিক ভর, \( M_{\text{HCl}} = 1 + 35.5 = 36.5 \) গ্রাম/মোল
সুতরাং, হালকা গ্যাস হওয়ায় অ্যামোনিয়া দ্রুত ছড়াবে এবং সাদা ধোঁয়ার বলয়টি (অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, \( \text{NH}_4\text{Cl} \)) হাইড্রোজেন ক্লোরাইড (\( \text{HCl} \)) গ্যাসের প্রান্তের কাছাকাছি তৈরি হবে।
বাস্তব জীবনে গ্রাহামের সূত্রের প্রয়োগ
- রান্নার গ্যাস লিকেজ: LPG (প্রোপেন ও বিউটেন) বাতাসের চেয়ে ভারী হওয়ায় লিক করলে মেঝের কাছাকাছি জমা হয়। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাস (মিথেন) বাতাসের চেয়ে হালকা হওয়ায় উপরের দিকে উঠে যায়।
- বেলুন চুপসে যাওয়া: হাইড্রোজেন (\(\text{H}_2\)) বা হিলিয়াম (\(\text{He}\)) গ্যাস ভর্তি বেলুন বাতাস ভর্তি বেলুনের চেয়ে দ্রুত চুপসে যায়, কারণ তারা বাতাসের (\(\text{N}_2, \text{O}_2\)) চেয়ে অনেক হালকা।
- আইসোটোপ পৃথকীকরণ: পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি এবং বোমা তৈরির জন্য ইউরেনিয়ামের দুটি আইসোটোপ \(^{235}\text{U}\) ও \(^{238}\text{U}\) পৃথক করতে গ্যাসীয় \(^{235}\text{UF}_6\) এবং \(^{238}\text{UF}_6\) এর ব্যাপন হার ব্যবহার করা হয়।
সীমাবদ্ধতা
গ্রাহামের সূত্রটি আদর্শ গ্যাসের (Ideal Gas) জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য। বাস্তব গ্যাসগুলো (Real Gases) উচ্চ চাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় এই সূত্র থেকে কিছুটা বিচ্যুতি প্রদর্শন করে। তবে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ও চাপে সূত্রটি যথেষ্ট নির্ভুল ফলাফল দেয়।
শেষ প্রসঙ্গ....
গ্রাহামের ব্যাপন সূত্র কেবল একটি গাণিতিক সমীকরণ নয়, এটি গ্যাসের আণবিক আচরণের এক মৌলিক প্রতিচ্ছবি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা থেকে শুরু করে পারমাণবিক প্রযুক্তির মতো জটিল ক্ষেত্রেও এর সফল প্রয়োগ রয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের নিবন্ধগুলিতে মন্তব্য করার সময় দয়া করে শ্রদ্ধাশীল এবং গঠনমূলক হন। অনুপযুক্ত, আপত্তিকর, বা অফ-টপিক মন্তব্য মুছে ফেলা হবে। আসুন ABC আইডিয়াল স্কুলের সকল পাঠকদের জন্য একটি ইতিবাচক এবং শিক্ষামূলক পরিবেশ বজায় রাখি। আপনার সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ!